সম্প্রতি পুত্র সন্তানের মা হয়েছেন জান্নাতুন নাহার জাকিয়া। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার সন্তানকে তিন দিন ভর্তি রাখতে হয় নবজাতকদের জন্য বিশেষায়িত একটি হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার সন্তানের ওজন কম, দেখা দিয়েছে বেশ কিছু শারীরিক জটিলতাও।
জাকিয়া বলেন, ‘আমি শাহবাগে থাকি, অফিস মহাখালী। সন্তান গর্ভে আসার পর প্রথম ৩ মাস আমি অফিস করি। সে সময় লক্ষ্য করি আমার প্রচুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। অফিসে আসা-যাওয়ার সময় যানবাহনের ধোঁয়া সহ্য করতে পারছিলাম না। বাসা থেকে বের হলেই আমার অস্বস্তি লাগত। তখন একদিন পত্রিকায় দেখলাম বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের মধ্যে ঢাকাও একটি। এরপরই অফিস বন্ধ করে দিই।’ তিনি বলেন, ‘এখন চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের ধারণা প্রথম ৩ মাসে আমি যে দূষণের শিকার হয়েছি তার কারণেই আমার গর্ভের শিশুর ক্ষতি হয়েছে। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠনে সমস্যা হয়েছে।’ শুধু জাকিয়া নন, রাজধানীতে বসবাসকারী তার মতো অধিকাংশ মা-ই একই রকম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেকেরই সন্তান জন্মদানে সমস্যা হচ্ছে বা সন্তানের নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিচ্ছে
চিকিৎসকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ুর শহর এখন ঢাকা। এর প্রভাবে অনেক মায়ের গর্ভের সন্তান নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে আসছে। একই সঙ্গে দূষণ প্রভাব ফেলছে শিশুদের সুষ্ঠু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনেও। তাছাড়া বায়ু দূষণের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই পৃথিবীতে আসছে শিশুরা (প্রি-ম্যাচিউর বার্থ), অনেক শিশুর ওজন আবার বেশ কম হচ্ছে। যা জন্ম-পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতা তৈরি করে।
আমরা এতদিন বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলতাম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া অদ্ভুত আচরণ করছে। এখন আর এটি ষড়ঋতুর দেশ নেই। অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে, বর্ষায় খরা হচ্ছে। এ ধরনের পরিবর্তন আমাদের সামাজিক অবস্থা ও খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে শিশুদের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় রোগজীবাণুর বিস্তার বেশি হয়। এটা শিশুদের সবচেয়ে বেশি এফেক্ট করে।
যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান যাচাই বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউ এয়ার’-এর তথ্য মতে, ২২ আগস্ট দুপুর ১-২টা পর্যন্ত ঢাকায় বায়ুর মান সূচক ছিল ৯৭। ওই সময় বায়ুতে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা ‘পিএম ২.৫’ প্রতি ঘন মিটারে ছিল ৩৯.৪ মাইক্রোগ্রাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বায়ু ‘স্পর্শকাতর গ্রুপের মানুষের (অনাগত সন্তান ও শিশু) জন্য অস্বাস্থ্যকর’।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক শারাবান তাহুরা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণের ফলে নারীদের গর্ভে থাকা শিশুরা ‘লেড পয়জনিং’-এর শিকার হচ্ছে। এর ফলে গর্ভের শিশু নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মা যখন দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকেন, বায়ুর মধ্যে যদি ডাস্ট বা কেমিক্যাল থাকে সেক্ষেত্রে শিশুর ওপর টেরাটোজেনিক ইফেক্ট পড়ে। মাতৃগর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ হতে পারে, তার হার্ট বা লাঙ্গসে অসঙ্গতি হতে পারে। অনেকসময় হার্টে ছিদ্রও হতে পারে দূষণের কারণে।’
তিনি বলেন, ‘একজন মা গর্ভবতী হওয়ার প্রথম ৩ মাসে শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ তৈরি হয়। এই সময়টায় যদি কোনো নারী বায়ু দূষণের শিকার হয় তাহলে তার গর্ভের সন্তানের বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাতও হতে পারে। এই সময়টা খুবই সেনসিটিভ।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু অনাগত নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব সব বয়সী শিশুদের জন্য অভিশাপ হিসেবে এসেছে। বর্তমানে শিশুরাই এর সর্বোচ্চ মূল্য দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলোতে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের তারতম্য ব্যাপকভাবে হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগের। গত ৫০ বছরে দেশে দিন ও রাতে উষ্ণতার হার বেড়েছে, অসময়ে বন্যা হচ্ছে, দেখা দিচ্ছে নদী ভাঙন। এসবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মাশুল দিচ্ছে শিশুরা।
দীর্ঘদিন এক পরিবেশে থাকার পর হঠাৎ করে পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা শিশুদের নেই। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় ডায়রিয়া ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি তাদের। জলবায়ুর প্রভাবে পুষ্টিহীনতায়ও ভোগে শিশুরা। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হিসেবে শিশুদের শিক্ষাজীবন ও মানসিক স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে এই জলবায়ু পরিবর্তন।
দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা বাড়ায় নতুন নতুন রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এক যুগ আগেও মশাবাহিত রোগ হিসেবে কেবল ম্যালেরিয়া ও ফাইলেরিয়ার কথা শোনা যেত। বর্তমানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো রোগ শিশুদের মারাত্মকভাবে গ্রাস করছে। সময়ে অসময়ে বৃষ্টির কারণে সর্দি-কাশির মতো রোগবালাইও বাড়ছে।
২০২১ সালে বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের দায় রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রতি দশকে সারা বিশ্বে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্বিগুণ হচ্ছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। ওই বছর সারাদেশে যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, তার অধিকাংশই ছিল শিশু। আর ঢাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ছিল ৭৭ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট তাপমাত্রার তারতম্য আর অধিক আর্দ্রতা ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণের ফলে নারীদের গর্ভে থাকা শিশুরা ‘লেড পয়জনিং’-এর শিকার হচ্ছে। এর ফলে গর্ভের শিশু নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মা যখন দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকেন, বায়ুর মধ্যে যদি ডাস্ট বা কেমিক্যাল থাকে সেক্ষেত্রে শিশুর ওপর টেরাটোজেনিক ইফেক্ট পড়ে। মাতৃগর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ হতে পারে, তার হার্ট বা লাঙ্গসে অসঙ্গতি হতে পারে। অনেকসময় হার্টে ছিদ্রও হতে পারে দূষণের কারণে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও জানায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৩৮০ জন। মারা গেছেন ৯৫ জন। মোট আক্রান্তের অধিকাংশই ছিল শিশু।
আবহাওয়ার এই বদলের কারণে বর্ষাকালে শহরগুলোতে যেমন বাহকনির্ভর রোগের প্রকোপ বাড়ছে তেমনি শুকনো মৌসুমে বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ। খুলনা, সাতক্ষীরা, ভোলার মতো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা এবং ঘন ঘন দুর্যোগ শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া অতিরিক্ত গরম শিশুদের স্বাভাবিক জীবন ও বেড়ে ওঠা ব্যাহত করছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় এসব অঞ্চলের শিশুরা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি হেপাটাইটিস এ, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েডের ঝুঁকিতে আছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘আমরা এতদিন বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলতাম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া অদ্ভুত আচরণ করছে। এখন আর এটি ষড়ঋতুর দেশ নেই। অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে, বর্ষায় খরা হচ্ছে। এ ধরনের পরিবর্তন আমাদের সামাজিক অবস্থা ও খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে শিশুদের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় রোগজীবাণুর বিস্তার বেশি হয়। এটা শিশুদের সবচেয়ে বেশি এফেক্ট করে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় ও বন্যাকবলিত এলাকার অনেক শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ফল হলো নদী ভাঙন। এর ফলে মুহূর্তের মধ্যে দরিদ্র হওয়া পরিবারগুলো তাদের শিশুদের নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে ঢাকায়। ঢাকায় এসে স্কুলে পড়া দূরের কথা ঠিকমতো তিন বেলা খাবার জুটছে না তাদের।
২০২১ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত গরম হচ্ছে যা বন্যা, খরাসহ নানা দুর্যোগ ডেকে আনছে। এর প্রভাবে হাজারো পরিবার গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে বস্তিতে থাকছে। শুধু তাই নয়, পড়াশুনা ছেড়ে তারা শ্রমিক হিসেবে নানা কাজে যুক্ত হচ্ছে। দেশে প্রায় ২ কোটি শিশুর মধ্যে স্কুল বাদ দিয়ে কাজে যোগ দেয়া শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। তাদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ শিশুর বয়স ১১ এর নিচে। এসব শিশুর মধ্যে ছেলেরা ট্যানারি, শিপইয়ার্ড, সবজি বিক্রি, দর্জির দোকান, মোটর ম্যাকানিক ওয়ার্কশপে কাজ করে। অধিকাংশ মেয়ে শিশুই অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে।
পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায় একটি মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপে কাজ করে মোহাম্মদ নাঈম (ছদ্মনাম) নামে ১৩ বছর বয়সী এক শিশু। তার কাজ মোটরসাইকেলের দুই চাকায় হাওয়া আর ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়া। নাঈম ঢাকা পোস্টকে জানায়, তার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে। ২০২১ সালে ভাঙনের কবলে পড়ে তাদের বাড়ি নদীতে চলে যায়। এরপর ৮ সদস্যের পরিবারসহ সে ঢাকায় এসে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বসবাস শুরু করে। গ্রামে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অভাব অনটনের কারণে আর পড়তে পারেনি সে। বর্তমানে ১৫০ টাকা রোজে (দৈনিক মজুরি) কাজ করছে।
আবহাওয়ার এই বদলের কারণে বর্ষাকালে শহরগুলোতে যেমন বাহকনির্ভর রোগের প্রকোপ বাড়ছে তেমনি শুকনো মৌসুমে বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ। খুলনা, সাতক্ষীরা, ভোলার মতো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা এবং ঘন ঘন দুর্যোগ শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া অতিরিক্ত গরম শিশুদের স্বাভাবিক জীবন ও বেড়ে ওঠা ব্যাহত করছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় এসব অঞ্চলের শিশুরা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি হেপাটাইটিস এ, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েডের ঝুঁকিতে আছে।
২০২১ সালের বাংলাদেশের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ কোটি ২৪ হাজার শিশু পড়াশুনা করত। এ বছর প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের পরোক্ষ প্রভাবই শিশু শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় মানসিক যন্ত্রণায়ও ভুগছে শিশুরা।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক বিষয়, যার জন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলো দায়ী। এতে মূলত বাংলাদেশের মতো আর্থিকভাবে কম শক্তিশালী দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব দেশে আবার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। বর্তমানে বাংলাদেশে অধিকাংশ দুর্যোগই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হচ্ছে। এতে মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে আগে শিশুদের পড়াশোনা, চিকিৎসা ও খাবার বাবদ বাবা-মা যে বাজেট রাখতেন এখন তারা সেটা কমাতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে কোনো রকম অপরাধ না করেই শিশুরা তাদের চাহিদাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে নানা ধরনের আকস্মিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। সময়ে অসময়ে বন্যা, শিলাবৃষ্টি এসে নস্যাৎ করে দিচ্ছে অনেক ফসল। এর প্রভাবও পরোক্ষভাবে পড়ছে শিশুদের ওপর। প্রতি পাঁচ বছরে একবার খরার কারণে বিপদে পড়ে বাংলাদেশের মানুষ, আর এক্ষেত্রে দেশের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে শিশুরা কাঙ্ক্ষিত পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফের ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড চিলড্রেন ২০১৯, চিলড্রেন, ফুড এবং নিউট্রেশন, গ্রোয়িং ওয়েল ইন এ চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ কৃষির ওপর জীবিকা নির্বাহ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা ও বন্যায় বাংলাদেশের কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ক্ষুধার মুখে পড়ার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর এর বিরূপ পড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের হাসপাতালগুলোয় তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এই হার ৭২ শতাংশেরও বেশি।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা দুর্যোগ হচ্ছে, এতে খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এর প্রভাবে শিশুরা কাঙ্ক্ষিত ও পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছে না। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকাগুলোর শিশুদের পুষ্টিহীনতায় ভোগার প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ুর শহর এখন ঢাকা। এর প্রভাবে অনেক মায়ের গর্ভের সন্তান নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে আসছে। একই সঙ্গে দূষণ প্রভাব ফেলছে শিশুদের সুষ্ঠু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনেও। তাছাড়া বায়ু দূষণের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই পৃথিবীতে আসছে শিশুরা (প্রি-ম্যাচিউর বার্থ), অনেক শিশুর ওজন আবার বেশ কম হচ্ছে। যা জন্ম-পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতা তৈরি করে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সদস্য, শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী সাধন সরকার বলেন, বয়স ভেদে শিশুর ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা ঠিক না থাকলে সাধারণভাবে তা অপুষ্টি হিসেবে ধরা হয়। বর্তমানে শিশুর পুষ্টির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন বড় হুমকি। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে চরম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। দরিদ্র পরিবারের হাজার হাজার শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। উপকূলের বহু দরিদ্র পরিবার
জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরের বস্তিতে, নদীর তীরের বেড়িবাঁধে বা রেললাইনের পাশে অবস্থান নিচ্ছে।
২০২২ সালের শুরুতে প্রকাশ করা একটি গবেষণায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, বিশ্বজুড়ে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন। দাবদাহ, বন্যা, দাবানলের মতো দুর্যোগগুলো চলতি বছর আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। বিশেষত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাওয়া শিশুদের ১৫-২০ শতাংশই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশাসহ নানা মানসিক সমস্যায় ভোগে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির (বিএসএমএমইউ) আবাসিক সাইক্রিয়াটিস্ট তৌহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন ব্যক্তির মানসিক বিকাশের বিষয়টি তার শৈশবের কয়েকটি বছরের ওপর নির্ধারিত হয়। এই সময়ে তারা যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যায় তাহলে এর ছাপ পড়ে শিশুর মনোজগতে। নদী ভাঙন, বন্যা ও দাবদাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ শিশুদের ওপর মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। এই দুর্যোগগুলো ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে, যার প্রভাব শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও থাকে। এই প্রভাব শিশু বড় হওয়া পর্যন্ত স্থায়ীভাবে থেকে যায়।