জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট ২৫ আগস্ট জেনেভায় সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছেন, বাংলাদেশে ভুল বা বিভ্রান্তিমূলকভাবে প্রচার হচ্ছে বলে জানিয়েছে তাঁর দপ্তর। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ই-মেইল বার্তায় তাঁরা এ দাবি করেছেন।
তবে ব্যাচেলেটের সফর নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমনটাই বলে আসছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট জেনেভায় তাঁর মেয়াদের শেষ সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক সংকটগুলো তুলে ধরেন তিনি। এতে বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সমলোচনা করেন তিনি। তাতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি তিনি। আর এটিকে সফলতা হিসেবে প্রচার করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে জাতিসংঘের কোনো উদ্বেগ নেই- এমন কথা প্রচার করা হয়েছে। গত রোববার সকালে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের ভিত্তিতে দেশ চালাচ্ছে সরকার।
আর শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, মানবাধিকার বা অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতিসংঘের কোনো উদ্বেগ প্রমাণিত হয়নি। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না- মিশেল ব্যাচেলেটর সর্বশেষ প্রতিবেদনেও তা প্রমাণিত হয়েছে। আর বাংলাদেশে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় থেকে মঙ্গলবার গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠানো হয়। এতে জানানো হয়, ‘আপনারা সকলেই অবগত রয়েছেন যে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার সরকার, সুশীল সমাজ এবং অন্য সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, যা তিনি তাঁর সফর শেষে বিবৃতিতেও তুলে ধরেছেন।’
এতে আরও বলা হয়, ‘যেহেতু সফরের সময়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন, ফলে গত ২৫ আগস্ট জেনেভায় ব্যাচেলেট তাঁর শেষ বিবৃতিতে বৈশ্বিকভাবে সম্পর্কযুক্ত বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য, জ্বালানি, অর্থনৈতিক সংকট, নাগরিক সমাজের স্থানের মতো বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। যে বিষয়গুলো বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশকে আক্রান্ত করেছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টিও তুলে ধরেছে। কারণ সেদিন রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসার বর্ষপূর্তি ছিল। ২৫ আগস্ট জেনেভায় দেওয়া বিবৃতিটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন ছিল না।’
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ঢাকায় দেওয়া বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা স্বীকার করে নিলে, তা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ বোঝায়। বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রচার ও সুরক্ষার জন্য অন্যান্য কাজ এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় প্রস্তুত।
বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সফরের চূড়ান্ত বিবৃতি এবং তার ভিডিও লিংকও সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের বাংলাদেশ সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
মিশেল ব্যাচেলেটকে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ দিয়ে নিয়ে এসেছে জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, মিশেল ব্যাচেলেটের সফরকে একটি মহল থেকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সমন্বিত চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে যাঁরা অস্থিতিশীল করতে চান, যাঁরা মানবাধিকারকে শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চান বা বর্তমান সরকারকে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত করতে চান, তাঁদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিটা সবচেয়ে বেশি।
মিশেল ব্যাচেলেটের সফর নিয়ে মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে, সেই সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের লবিস্টরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিতে থাকে। এ সময়ে উদাহরণ হিসেবে হেফাজতের শাপলা চত্বরের ঘটনা তুলে ধরেন তিনি।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকারপ্রধানের বৈঠক নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ বৈঠকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন, জাতিসংঘ যাতে সরকারকে কিছু করার জন্য বাধ্য করে- সুশীল সমাজ এ দাবি করেছিল। মিশেল ব্যাচেলেট পরিস্কারভাবে বলেছিলেন, নির্বাচনের যে বিষয় দাবি করা হয়েছে, তা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ওয়েবসাইটগুলো থেকে খবর প্রচার করা হয়, তারাসহ বিএনপি খুব সক্রিয় হয়ে উঠল মিশেল ব্যাচেলেটের সফরের সময়ে। সুশীল সমাজের একটি অংশের প্রতিনিধির কঠোর সমালোচনা করে তাঁদের ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি মিশেল ব্যাচেলেটের কাছে প্রকাশ করতে পারা গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
জাতিসংঘ থেকে ৭৬ জনের তালিকা বিষয়ে তিনি বলেন, এ নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে নিখোঁজদের খুঁজে এ পর্যন্ত ১০ জনের হদিস মিলেছে। সেই প্রতিবেদন জেনেভায় জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি থাকে ৬৬ জন। এ ৬৬ জনের ২৮ জন দাগি আসামি। দাগি আসামি বিচার এড়াতে লুকিয়ে থাকে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এদের খুঁজে বের করতে আমরা জাতিসংঘের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কখনোই এটা হবে না- ৬৬ জনের সবাইকেই আমরা খুঁজে পাব। খুঁজে পেতেও পারি, নাও পারি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। ৬৬ জনের মধ্যে ১০টি পরিবার কোনো ধরনের তথ্য সরকারকে দেয়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকারপ্রধানের সফর নিয়ে এতদিন পর কেন সংবাদ সম্মেলন? জানতে চাইলে মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, আমরা গত দুই দিন ধরে দেখছি, মিশেল ব্যাচেলেটের সফর নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করা হচ্ছে।
মিশেল ব্যাচেলেটের সুপারিশগুলো নিয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের বিচার বিভাগ, জাতীয় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ স্বাধীন। বাহিনীগুলোর মধ্যে জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে বলেই র্যাবের ৪০০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১ হাজারের ওপর পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একই প্রতিষ্ঠানের জনবল দিয়ে গ্রহণযোগ্য তদন্ত হবে না- এর কোনো যুক্তি আমি দেখি না। এর বাইরে সুশীল সমাজকে দিয়ে তদন্ত করালে তারা প্রতিবেদন দেবে- শাহরিয়ার আলমের নেতৃত্বে এ খুনগুলো হয়েছে।
মিশেল ব্যাচেলেট কি সরকারের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়েছেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, আমরা কখনোই দাবি করছি না- আমরা সম্পূর্ণ ঠিক। আমাদের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমরা এটা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি- আমাদের যথেষ্ট সদিচ্ছা রয়েছে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির আরও উন্নতি করার।