১. আজ পয়লা সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের কালজয়ী সিপাহসালার মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, মহানায়ক বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি প্রায় ভুলতে বসেছি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের এ মহানায়ককে। এ কারণেই হয়তো Rudyard Kipling লিখেছিলেন-
“God and soldier all men adore,
In times of danger and not before.
When danger is over and things are righted,
God is forgotten and poor soldier is slighted.”
২. জেনারেল ওসমানীর ৬৬ বছরের (১ সেপ্টেম্বর ১৯১৮-১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪) জীবন ছিল এক মহাসাগরের মতো, যার ওপর দিনের পর দিন আলোচনা বা লেখালেখি করলেও শেষ করা যাবে না।
৩. সামরিক বাহিনীতে অনেকেই জেনারেল হন বা করা হয় বটে, কিন্তু মিলিটারি লিডার হতে পারেন না, যাদের মধ্যে অনেকেই কেবল শোভাবর্ধন বা নিজস্ব স্বার্থ হাসিল ছাড়া দেশ-জাতি তো দূরের কথা, নিজস্ব বাহিনীরও কোনো কাজে আসেন না। নিজস্ব বাহিনীর জেনারেলরা যদি সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ বাহিনীর জেনারেলের তুলনায় বাস্তববাদী জাতীয়তাবোধসম্পন্ন দেশপ্রেমিক, প্র্যাগম্যাটিক, প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী, কৌশলী, তেজস্বী, যুদ্ধ ও সৈন্য পরিচালনায় সুদক্ষ সমরবিদ, শত্রুর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন এবং সর্বোপরি মহান সৃষ্টিকর্তা ও সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তায়ালার প্রতি প্রচণ্ড আস্থাশীল না হন, তাহলে সেসব জেনারেল শুধু সামরিক বাহিনীর শোভাবর্ধনের কাজেই আসবেন। ক্রান্তিলগ্নে বা আপৎকালীন সময়ে তাদের দিয়ে দেশের কোনো উপকার হবে না এবং দেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের ওপর নির্ভরও করা যাবে না। কেননা, যেকোনো দেশের সামরিক বাহিনীতে জেনারেলরাই নীতি প্রণয়ন, প্রয়োগ ও যুদ্ধ পরিচালনা করে থাকেন। এমন সফল জেনারেল যুগে যুগে, দেশে দেশে ও বিভিন্ন জাতিতে অনেক ছিলেন বলেই সেসব দেশ ও জাতি বিশ্বে মাথা উঁচু করে টিকে আছে। যেমন- খালিদ বিন ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাসেম, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন্ বখতিয়ার খিলজী, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর, বৈরাম খাঁ, মানসিংহ, জেনারেল আইসেনহাওয়ার, ফিল্ড মার্শাল আরভিন রোমেল, জেনারেল হ্যান্স গুদেরিয়ান, জেনারেল দ্য গল, ফিল্ড মার্শাল উইলিয়াম জোসেফ স্লিম, ইরানি জেনারেল কাসেম সুলেইমানি প্রমুখ। আমরাও গর্ব করে বলতে পারি, আমাদেরও এমন একজন জেনারেল আছেন যিনি বাংলাদেশ ও বিশ্বের যুদ্ধেতিহাসকে আলোকিত করেছেন এবং নিজ দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিলেন, তিনি হলেন জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।
৪. একটি পরাধীন দেশকে স্বাধীন দেশে পরিণত করতে হলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও জাগরিত করার জন্য উঁচুমানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনিভাবে দখলদার আগ্রাসী বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় সামরিক বাহিনী ও এর নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান ও দুর্ধর্ষ সামরিক নেতার। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও জাগরিত করার জন্য আমাদের ছিলেন কিংবদন্তির মহানায়ক, অসাধারণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নেতা সিংহপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর সামরিক নেতৃত্বের জন্য ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কিংবদন্তি ক্ষণজন্মা পুরুষ জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী, যিনি তার অসাধারণ মেধা, যোগ্যতা, নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, বাস্তবসম্মত কার্যকর সমরকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে তুলনামূলকভাবে বহুগুণে বেশি শক্তিশালী শত্রুবাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ফলাফলকে অনুক‚লে নিয়ে আসেন, যা কল্পনাকেও হার মানায়।
৫. বিশ্বের ইতিহাসে বিরল সম্মান, গৌরব ও ঐতিহ্যের অধিকারী ব্যক্তিত্ব : বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, প্রথম সেনাপ্রধান, প্রথম জেনারেল, বিশ্বের তিন-তিনটি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও তিনটি দেশের সেনাবাহিনীতে চাকরি করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, অবসরকালীন সময়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতাযুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনীর নেতৃত্ব প্রদানকারী। তিনিই একমাত্র সামরিক অফিসার যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ১৯৬৭ সালে অবসর গ্রহণ করার চার বছর এক মাস ২৪ দিন পর পুনরায় সামরিক পোশাক পরিধান করে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেন। দেশ ও পৃথিবীর ইতিহাসে সমৃদ্ধিশালী ও অত্যধিক সম্মানজনক বিরল এ অবস্থানের অধিকারী হলেন জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।
৬. সামরিক পোশাক ছাড়ার প্রায় চার বছর পর জেনারেল ওসমানী মাতৃভূমির এ চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে পুনরায় তা পরিধান করে বাংলাদেশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, যা বিশ্বে এক বিরল উদাহরণ। একবার চিন্তা করে দেখুন তো, সে সময়ে যদি ওসমানীর মতো কালজয়ী তীক্ষ্ণ মেধাবী, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, দক্ষ, বিচক্ষণ, তিনটি যুদ্ধের বিরল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, চতুর্মুখী গুণাবলির অধিকারী সর্বজনগ্রাহ্য সিনিয়র সামরিক নেতা দৃশ্যপটে না আসতেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এ যুদ্ধের কী শোচনীয় অবস্থাই না হতো! জেনারেল ওসমানী তার বলিষ্ঠ, সুদক্ষ নেতৃত্বে ও যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করে মুক্তিবাহিনীকে সুসংগঠিত করে দিকনির্দেশনা, অনুপ্রেরণা এবং পরিচালনার মাধ্যমে দেশকে শত্রুমুক্ত করে বহু প্রত্যাশিত নতুন একটি দেশ, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রেখেছেন অনন্য অবদান।
৭. ইতিহাস সৃষ্টিকারী দূরদর্শী চিন্তাচেতনার অধিকারী অসাধারণ প্রতিভাবান কালজয়ী পুরুষ ওসমানীদের বারবার জন্ম হয় না। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ধূমকেতুর মতো এদের আবির্ভাব হয়। জাতির মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ থাকলে তারা এ বীরপুরুষকে সম্মান করে। আর তা না হলে কালচক্রে এরা হারিয়ে যান। চিরকুমার জেনারেল ওসমানী তার সারাটি জীবন কাটিয়েছেন এ দেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য, উন্নতির জন্য এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। উৎসর্গ করেছেন তার জীবন-যৌবন, সহায়-সম্পত্তিসহ সব কিছু। অবহেলিত বাঙালি মুসলমানদের ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবেশের জন্য তিনি সব প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং এর সফলতাও অর্জন করেছেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার পথকে উন্মুক্ত করে এবং ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর একে একে এ রেজিমেন্ট সমৃদ্ধ হতে থাকে, যা স্বাধীনতাযুদ্ধে নিয়ামকের ভ‚মিকা পালন করে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি কখনো পিছু হটেননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, অস্ত্রমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যতদিন টিকে থাকবে বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী বেঁচে থাকবেন, স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে এ দেশের মাটি ও মানুষের মনের মণিকোঠায় মুক্তির সুউজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে।
লেখক : সামরিক ইতিহাসবিদ ও
নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: hoque2515@gmail.com