নবনীতা চক্রবর্তী
আমরা এমন ঘুম চাইনি পারমিতা। তোমার জন্য নয় পৃথিবীর আর কোন মানুষের জন্যও নয়। কোন দিন না জাগার বেদনা নিয়ে অবিরাম ভার নিয়ে কোন স্বপ্নের অপমৃত্যু আর চাইনা।
একসময় সমাজ ছিল ‘আমরা’ কেন্দ্রিক ধারনায় লব্ধ। যা কিছু সবটাই আমাদের, কর্মফল ও দ্বায়িত্ব যাবতীয় ব্যক্তি বিশেষ নয় ব্যক্তি নির্বিশেষ ছিল। পরবর্তীতে আমরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠলাম, ব্যক্তি মানুষের নানা অন্তমুখী চিন্তা তথা অস্তিত্ববাদ ক্রমশ আমাদের মধ্যে প্রোথিত হতে লাগলো আর আমরা পরস্পরের কাছ থেকে খুব সূক্ষ্যভাবে বিছিন্ন হতে থাকলাম। নানামুখী সংকটের শুরু তখন থেকেই। অবসাদ, নৈরাশ্যবাদ যেন আরো এক বিপন্ন বিস্ময় হয়ে আমাদের অন্তর্গত রক্তের মধ্যে খেলা করে তাই বুঝি পারমিতারা সমাজের সাথে বুঝে উঠবার রসদ জোগাতে পারেনা। আলবেয়ার কামু তার মিথ অব সিসিপাস–এ বলে, ‘There is only one really serious philosophical question, and that is suicide’ পারমিতা আমাদের কাছে এক অস্তিত্বের একান্ত গভীর অনুভুতি, বেদনা আর বিচ্ছিন্নতার এক ক্লান্তিকর ক্ষত, সম্ভাবনার অপমৃত্যু দিনশেষে কাটাতারের প্রজাপতি।
জাঁ পল সার্ত্রের লেখা নসিয়া উপন্যাস ব্যক্তি জীবনের নিঃসংঙ্গতাবোধের এক অসাধারণ উপস্থাপন। যেখানে চিত্রিত হয়েছে এন্টোআইন রোকেন্টিন নামে এক ব্যক্তি কীভাবে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তার পরিবেশ তার প্রিয়জন এমনি তার সবচেয়ে কাছের মানুষ তার প্রেমিকা অ্যানির কাছে থেকে ক্রমে বিছিন্ন হয়ে গিয়েছেন। আবার আমাদের জীবনানন্দ দাশের লেখনীতেও ‘আমারই মুদ্রা দোষে হতেছি একেলা’ । এই যে আমরা ক্রমশ একেলা হচ্ছি, এন্টোয়াইন হচ্ছি তার কারণ কী? আমাদের অবসাদ, ক্লান্তি ,যন্ত্রনাকে ঠেলে কেন বেচেঁ থাকার কোন তাগিদ অনুভব করছি না। কেন জীবন বার বার পরাজিত যাচ্ছে মৃত্যুর কাছে। জীবনের প্রতি এত বিতৃষ্ণা কেন জন্মাচ্ছে ?
কারণ যা চকচকে সুগন্ধে মোড়া ফাঁপা অন্তঃসারশুন্য যে নাগরিক জীবন বেছে নিয়েছি আমরা সেখানে কোন আরাম নেই কোন শান্তি নেই, নেই বিশ্রাম শুধু আছে অবিরাম ছুটে চলা। আমরা একে অপরের থেকে ক্রমশদূরবর্তী হচ্ছি। মহানগরের তপ্ত দুপুরের গিজগিজ করা মানুষদের মধ্যে যোজন যোজন গহব্বর। নাট্যকার লুইজি ব্রায়ান্টের ‘দ্য গেম’ নাটকে দেখা যায় এক তরুণ তরুণী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাদের নিয়ে খেলা শুরু করে জীবন–মৃত্যু নামে দুটো অতিলৌকিক চরিত্রটি। জীবন–মৃত্যুর ঘূর্ণায়মান নিরন্তন দ্বন্দে জীবন জয়ী হয়। জীবনে যাই ঘটুক, যত ঝড়, আঘাত আর দুঃখের তীব্রতা আসুক, আসুক হতাশা–জীবন অপার সম্ভাবনাময় তাই আত্মহত্যা নয়। এমন একটি বার্তা বহন করে লুইজি ব্রায়ান্টের ‘দ্য গেম’। সেখানে জীবনের অপার সম্ভাবনাকে ভালোবাসার আশা নিয়ে আবার নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা নিয়ে জেগে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে এই স্বপ্ন বা আশা ব্যর্থ হওয়ার কারণ কী? কেন আত্মহত্যার মতো হত্যার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনবোধ ও বেচেঁ থাকার তীব্র ইচ্ছার পরাজয় ঘটছে?
মানুষ কোন চিরন্তন ধারণায় বদ্ধ নির্দিষ্ট সীমায় বাঁধা নয়। তার অবস্থান, পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর বিবেচনা করে বা কেন্দ্র করে গড়ে উঠে ব্যক্তির মূল্যবোধ, ইচ্ছা, আগ্রহ ও অনুভূতি। মানুষকে প্রতিনিয়ত সময়ের সাথে বুঝে মানুষ হয়ে উঠতে হয়। তাহলে কি পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যে আমরা আছি যে, পারমিতারা আর সেই মানুষ হয়ে উঠবার লড়াইটা লড়তে চায় না। মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায়, মানুষ হতাশ হলে ঠুনকো কারণে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তখন তিনি নিজেকে একা মনে করে এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আপাতদৃষ্টিতে, অন্যদের কাছে মৃত্যুর কারণ ছোট মনে হলেও ওই কারণ ওই মুহূর্তে ওই ব্যক্তির জন্য অনেক বড় কারণ হয়ে সামনে এসেছিল।
অনেকটা ঐ বালক আর ব্যাঙদের গল্পের মতো, পুকুরের ঢিল ছোঁড়াটা তাদের কাছে অত্যন্ত আনন্দের কিন্তু তা ফল অত্যন্ত মারাত্মক। তাদের এই আনন্দ অন্যের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই যে বিষয়টি আপনার আমার জন্য অত্যন্ত তুচ্ছ আপনি বা আমি কোন কারণই খুঁজে পাইনা জীবনকে শেষ করে দেওয়ার জন্য সেখানে যিনি আহত রক্তাক্ত তার কাছে সেটাই অনেক বড় কারণ। তাছাড়া মানুষ কিন্তু কারণের জন্যই আত্মহত্যা করে তা কিন্তু নয় বরং যখন সে অপমানিত বোধ করে যখন সে কোন ব্যক্তি, আচরণ,পরিবেশ, পরিস্থিতির দ্বারা বারংবার সহিংসতার শিকার হয় আর সেই মুর্হুতে সহানুভুতির বদলে যখন সে একাকিত্ববোধ করে নিসঙ্গতাবোধ করে তখনই হতাশার অন্ধকারে জীবনের সুন্দর অর্থ তার কাছে অধরা হয়ে যায়। ফলাফল জীবননাশ। এই জীবনের ইতি ঘটানো সেই ব্যক্তিটির কাছে একটা সমাধানের মতো কাজ করে। যাবতীয় যন্ত্রনা ও ব্যর্থতা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে এই পথকে একমাত্র বিবেচনা করে। মনোবিজ্ঞানীরা একে বলেন টানেল ভিশন অর্থাৎ একটি চিন্তার শুন্যতা তৈরি হওয়া। যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা হ্রাস পায়।
মানুষের এই চিন্তা, অবসাদ বিষন্নতা আর ক্ষয়ে যাওয়া সহ্য শক্তি এবং মানিয়ে নেওয়ার যে অপরিপক্কতা সেটা একদিনে হয় না, তাই এই সমস্যা একদিনের নয়। পারমিতাও হয়ত বিষন্ন ছিল, আহত ছিল, ভীত ছিল ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে গিয়েছিলো। অথচ নির্মমতা হল আমরা কেউ সেটা বুঝতে পারলাম না অথবা অনেক ক্ষেত্রে সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যে ধরলাম না। প্লেটো তার ‘ক্রাইসিস অফ ফ্রেন্ডশিপ’ বইতে প্রশ্ন করেছিলেন মানুষ আত্মহত্যা করে কেন? উত্তর ছিল সহায়হীন হয়ে পড়লে। সহায়ক তবে কে? প্লেটোর উত্তর–বন্ধু। প্লেটো পরবতীতে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন উপযোগিতা ও আনন্দভিত্তিক তত্ত্বের ভিত্তিতে তবে গুরুত্বপুর্ণ বিষয়টি হল কাছের মানুষের সাহচর্য।
এখানে কাছের মানুষদের ভূমিকা আর দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। কারণ খুব সাধারণ বোধেই মানুষ বিপন্ন হলে তার কাছের মানুষের সান্নিধ্য সবার আগে খোঁজে। তাই একটু শোনার প্রবনতা কিন্তু রোধ করতে পারে অনেক দুর্ঘটনা। সহমর্মিতা ও মন খুলে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়ে উঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রিয় জীবন সুন্দর করতে যে প্রেম, আশা, বিশ্বাস, সহানুভুতি আর মানবিকতার প্রয়োজন হয় সেটা প্রিয়জন ছাড়া কি সম্ভব? WHO এর মতে মানসিক সুস্থতা বলতে বুঝায় কোন ব্যক্তি যখন নিজের ক্ষমতা বুঝতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক চাপসমূহ মানিয়ে নিতে পারে, উৎপাদনশীলতার সাথে কাজ করে নিজ সম্প্রদায়ে অবদান রাখতে পারে। আর এই যোগ্যতা বা অবস্থাগুলো অর্জন করতে হলে যে সহমর্মিতা প্রয়োজন, যে সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন তা বির্নিমাণ করার দ্বায়িত্ব কাদের? যে শৈশব, কৈশোর হবে আনন্দময় যে তারুণ্য হবে সাহসী, উদ্যোমী সেখানে সেই উদ্যোম, সাহস কেন নিরাশার অন্ধকার গহব্বরে হারিয়ে যাবে? যে সুন্দর সুনিশ্চিত ভবিষৎ নির্মাণের আমরা স্বপ্ন দেখি তা পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে আমাদের পারমিতাদের মৃত্যু নিয়ে ফল্প্রসূ চিন্তা করার সময় এখনই। আমরা হয়ত আত্মহত্যা দিবস পালন করব, আলোচনা করব সভা–সেমিনার করব কিন্তু দিনশেষে এই পারমিতাদের ঝরে পড়া রোধ করতে না পারলে এক অন্তসারশূন্য ভালোবাসাহীন মনুষ্য সমাজ নিয়ে কী করব? পারমিতাদের মতো সম্ভাবনাময় জীবনগুলোর মহীরুহ হয়ে উঠতে নিজেদের প্রশ্ন করা ছাড়া আর কি কোন উপায় আছে আমাদের??
নবনীতা চক্রবর্তী : শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।