বৈশ্বিক মহামারি-পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। এ ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতিতেও। তবে সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংক-ব্যবসায় এবং বাণিজ্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে অর্থনীতির কয়েকটি সূচক ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে। বিশেষ করে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি ব্যয় সংকোচন নীতির সুফল মিলছে অর্থনীতিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের প্রধান উৎস রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স। আর এ দুটির উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে স্বস্তির আভাস মিলেছে। এখন তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর ভর করেই গত অর্থবছরের মতো রপ্তানি আয়ে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে।
রেমিট্যান্সে নানা ছাড় ও সুবিধা দেওয়ায় ইতিবাচক সাড়া মিলছে। আগস্ট মাসে ২০৩ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ১৯ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। যা গত বছরের (২০২১) আগস্ট মাসের চেয়ে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ১৮১ কোটি টাকা। ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্স সংক্রান্ত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের সদ্যবিদায় হওয়া মাস আগস্টে ২০৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের আগস্টে এসেছিল ১৮১ কোটি ডলার। সে হিসাবে গত বছরের একই সময়ের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৯ কোটি ডলার।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মতো রপ্তানি আয়েও সুবাতাস বইছে। গত আগস্ট মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলার আয় করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার বেশি ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) পণ্য রপ্তানি থেকে ৮৫৯ কোটি ১৮ লাখ ডলার দেশে এসেছে, যা গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। এটি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। এ দুই মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়েছে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ।
সম্প্রতি প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৭১১ কোটি ২৬ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি আয় হয়েছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। দুই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতিতে রপ্তানি আয় কমবে বলে আশঙ্কা করছিলেন রপ্তানিকারকরা। কিন্তু কোরবানির ঈদের ছুটির কারণে আট-দশ দিন পোশাক কারখানাসহ অন্য সব কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরও অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। দ্বিতীয় মাস আগস্টেও সেই উল্লম্ফন অব্যাহত আছে।
আর এতে দেশের অর্থনীতির জন্য ‘খুবই ভালো’ লক্ষণ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক আতিউর রহমান। তিনি বলেন, রেমিট্যান্সের পর রপ্তানি আয় বাড়ায় অর্থনীতিতে যে চাপ দেখা দিয়েছিল, এই দুই সূচকের ইতিবাচক ধারায় তা অনেকটা কেটে যাবে।’
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ৪৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন দেশের রপ্তানিকারকরা। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৩০ কোটি ডলার। গত বছরের আগস্টে রপ্তানি হয়েছিল ৩৩৮ কোটি ৩১ লাখ ডলারের পণ্য। এ হিসাবেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। জুলাই মাসে ৩৯৮ কোটি ৪৮ লাখ ২০ হাজার (প্রায় ৪ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি করে ৫২ দশমিক শূন্য আট বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে বেশি আয় হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এসেছে ৪১৩ কোটি ৪০ লাখ (৪.১৩ বিলিয়ন) ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ।
আগামী দিনগুলোতেও রপ্তানি বাড়ার আশা করছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প-মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি বলেন, নানা ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও দুই মাসে সার্বিক রপ্তানিতে ২৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অবশ্যই একটা ভালো দিক। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ২৬ শতাংশের বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে এই উল্লম্ফন আমাদের আশান্বিত করেছে। এই সংকটের সময় রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়াটা খুবই দরকার ছিল। এর মধ্য দিয়ে রিজার্ভ বাড়বে। ডলারের বাজারে যে অস্থিরতা চলছে, সেটাও কেটে যাবে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চলছে। রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য প্রণোদনাসহ নানা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে জুলাই মাসে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে