গুরুত্ব বাড়ছে মোংলা বন্দরের। করোনাসহ নানা কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ সমুদ্র বন্দর কার্যত সচল হয়ে উঠছিল না। নানা অবকাঠামোগত ত্রুটিও ছিল। শেষপর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মোংলা বন্দরও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে এ বন্দর থেকে বিপুল গাড়ি খালাস করা হয়েছে। কন্টেইনার বাণিজ্য পুরোদমে চালু করার লক্ষে এই প্রথম ৮ মিটার গভীরতার কোনো জাহাজ মোংলা বন্দরে ভিড়েছে। মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সকালে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমসিসি টোকিও’ জাহাজটি ৩৭৭ টিইইউএস পণ্য বন্দরের ৫ নম্বর জেটিতে ভিড়েছে বলে সূত্র জানায়। পুরোদমে মোংলা বন্দর চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ অনেকটা কমবে। ফলে ব্যবসায়ীদেরও উভয় বন্দর থেকে সুবিধা মিলবে।
এ বিষয়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমডোর মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ তরফদার গণমাধ্যমকে বলেন, এবারই প্রথম কন্টেইনার নিয়ে ৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দর জেটিতে ভিড়েছে। এটি ব্যবসায়ীদের তো বটে দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, জাহাজ ভেড়ানোর লক্ষে দীর্ঘদিন ধরে বড় ধরনের খননকাজ করা হয়েছে। মূলত বড় আকারের খননের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে।
আব্দুল ওয়াদুদ তরফদার আরো বলেন, এ জাহাজ ভেড়ানোর বিষয়টি আমরা মূলত ট্রায়াল হিসেবে নিয়েছি। পুরোপুরি সফল হলে এখন থেকে কন্টেইনার বাণিজ্য পুরোদমে শুরু করা যাবে। বন্দরের স্থায়ী জেটিতে এর আগে কখনো ৮ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো যায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকার চট্টগ্রাম বন্দরকে রিজিওনাল বা আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগও তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। বড় আকারে কন্টেইনার রাখার জন্য পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মিত হচ্ছে। বে-টার্মিনালের কাজও চলছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মাতারবাড়ীতে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে। সবমিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর বিশাল আকার ধারণ করছে। ফলে ক্রমবর্ধমান চাপ সামলাতে মোংলা বন্দরকে অধিকতর সচল করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার কন্টেইনার জাহাজ যাতে মোংলা বন্দরে সহজে ভিড়তে পারে, তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরে আসা নৌ-পরিরবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ট্রানজিট চুক্তি অনুসারে ভারতের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারবে এবং সেখান থেকে সড়ক পথে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মালামাল নিয়ে যেতে পারবে। এজন্য চট্টগ্রাম বন্দরে ভারতের জাহাজের ট্রায়াল রান (পরীক্ষামূলক চলাচল) হয়েছে। আরো ট্রায়াল হবে। সেই বাড়তি জাহাজের চাপ সামাল দেওয়ার জন্য পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল, ওভারফ্লো ইয়ার্ড নির্মিত হয়েছে। চাপ সামাল দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর প্রস্তুত আছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে প্রজ্ঞাপন হয়ে গেলে নিয়মিতভাবে ভারতীয় জাহাজ পণ্য নিয়ে আসা শুরু করবে।’
সূত্র মতে, ভারতের বিশালত্বের কারণে বাংলাদেশের দুটি বন্দর ব্যবহার করলে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধি হবে। ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির আওতায় ভারতের ব্যবসায়ীরা দু’বন্দরের সুবিধা পেতে এরই মধ্যে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন। এরই মধ্যে কলকাতা সমুদ্র বন্দর থেকে ‘এমভি রিশাদ রায়হান’ নামের একটি জাহাজ মোংলা বন্দরে পণ্য নিয়ে এসেছে। মোংলা বন্দরে পণ্য নামিয়ে একটি চালান সিলেটের তামাবিল সড়কপথ এবং কুমিল্লা-বিবিরবাজার সড়কপথ ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য উত্তর-পূর্ব রাজ্য আসাম ও মেঘালয়ে নেওয়া হবে। এ জাহাজ মূলত খোলা পণ্য ব্যবহারকারী জাহাজ। তবে কন্টেইনার জাহাজ ভেড়ানোর জন্য প্রয়োজন ছিল গভীরতার। এ গভীরতার বিষয়টি পরিপূর্ণ হওয়ায় ৮ মিটার গভীরতার বাণিজ্যিক জাহাজ ভেড়ানো হয়। মূলত পশুর নদীর নাব্যতা কম থাকায় সাত বা সাড়ে সাত মিটারের অধিক গভীরতার জাহাজ মোংলা বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারতো না। পশুর নদী খনন করার পর গভীরতা অনেকটা বেড়ে যায়। পূর্বে পশুর নদীর মাঝ বরাবর গভীরতা ইতিবাচক ছিল না। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পশুর নদী খনন করে জেটিতে ৮ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানোর জন্য কার্যকরী করে তোলে। ফলে কন্টেইনার জাহাজ ভেড়ার সফলতা মেলে।
সূত্র মতে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারত ও বাংলাদেশ সরকার আলাপ-আলোচনা চালিয়ে আসছিল। উভয় দেশের মধ্যে ২০-১৮ সালের অক্টোবরে সমুদ্র বাণিজ্যের চুক্তি হলেও নানা কারণে এটি কার্যকর হচ্ছিল না। চলছিল ধীরগতিতে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আগ্রহ থাকলেও করোনা মহামারিসহ নানা জটিলতায় গত চার বছরে এ চুক্তির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। মোংলা বন্দর থেকে কলকাতা বন্দর অনেকটা কাছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়ীরা সমুদ্র বাণিজ্যের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। কারণ স্থলপথ থেকে সমুদ্র বাণিজ্যে অর্থনৈতিক সাশ্রয় বেশি। চুক্তির পর ভারতের অনেক ব্যবসায়ী মোংলা বন্দর ঘিরে নিজেদের পরিকল্পনা সাজাতে থাকে। গত ২০২০ সালের ২১ জুলাই কলকাতার শ্যামপ্রসাদ মুখার্জি বন্দর থেকে ট্রানজিটের প্রথম একটি চালান চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। চালানটি এ বন্দরেরে মাধ্যমে সড়কপথে ভারতের ত্রিপুরায় যায়। এর মধ্যে করোনা হানা দিলে আবার সবকিছু থমকে যায়। শেষপর্যন্ত করোনাকাল একটু সহনীয় হলে গত ৮ আগস্ট একটি পরীক্ষামূলক আর একটি চালান মোংলা বন্দরে পৌঁছায়। এভাবে মোংলা বন্দর দিয়ে বেশ কয়েকটি জাহাজ ভারত থেকে পণ্য নিয়ে সেভেন সিস্টার খ্যাত রাজ্যগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে। মোংলা বন্দরের কন্টেইনার বাণিজ্য শুরু হলে সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো ভারত ছাড়াও বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করতে পারবে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ-ভারত নৌপথে পণ্য পরিবহন ক্রমাগতই বাড়ছে। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে দুদেশের মধ্যে সাড়ে ৪৭ লাখ টন পণ্য পরিবহন হয়েছে, যা ২০০১ সালের পর সর্বোচ্চ।
উল্লেখ্য, নৌ বাণিজ্যের জন্য ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড (পিআইডব্লিউটিটি) চলমান রয়েছে। ২০০০ সালের আগপর্যন্ত শুধু ভারতীয় জাহাজের মাধ্যমে পণ্য আনা-নেওয়া করা যেত। ২০০০ সালের পর এ কাজে বাংলাদেশের জাহাজও সম্পৃক্ত হয়। প্রটোকল অনুযায়ী যদিও আমদানি-রপ্তানিতে দুই দেশের সমান সংখ্যক জাহাজ ব্যবহার হওয়ার কথা।