অস্থির ডলার বাজার। দফায় দফায় বাড়ছে দাম। এতে বিদেশি মুদ্রায় ঋণধারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ জমেছে। কারণ সাত মাসের কম সময়ে দেশের মুদ্রার দরপতন হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। ফলে ৫ বছর আগে যারা বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়েছেন তাদের ধারণার চেয়ে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
শিল্পে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় অর্থায়নের জন্য দেশি উৎসের পাশাপাশি এখন বেশিসংখ্যক উদ্যোক্তা বিদেশি ঋণে ঝুঁকছেন। কম সুদের বলে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা ব্যবসায়ীরা ডলারের দর বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন। ফলে দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদ-আসলে যে টাকা পরিশোধ করতে হতো, এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হবে।
বলা হচ্ছে, দেশের তুলনায় বিদেশি ঋণে সুদহার কম। তবে ঋণের অর্থ ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রায় দেশে আসে আর তা পরিশোধও করতে হয় বিদেশি সেই মুদ্রায়। এ কারণে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার যদি বেড়ে যায়, তাহলে ঋণগ্রহীতাদের বেশি দামে তা কিনতে হবে। ফলে তাদের প্রত্যাশিত অর্থের চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হতে পারে।
বিদেশি ঋণের বাড়তি এ বোঝাকে অর্থনীতির জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় বিদেশি ঋণের চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আর এই চাপ সামাল দিতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
গত কয়েক বছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে, সেটি স্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে বেসরকারি খাত। টাকার দরপতনে বিদেশি ঋণের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে। কারণ যারা প্রতি ডলার ৮৪-৮৫ টাকা হিসাব ধরে ঋণ নিয়েছে, তাদের এখন ১০৬-১০৭ টাকা দিয়ে ডলার কিনে সেই ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে তিনি রাজস্ব বাড়ানোর ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, সরকার যদি দ্রুততার সঙ্গে রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারে, তাহলে ভালো সমাধান আসবে।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট শামস মাহমুদ বলেন, এখান থেকে ৭-৮ বছর আগে দেশি ঋণে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ সুদ গুনতে হতো। তখন বিদেশি ঋণের সুদ ছিল ৫ বা ৬ শতাংশ। ফলে অনেকে বিদেশি ঋণে ঝুঁকে যায়। লোকাল কারেন্সিতে ঋণ যারা নিয়েছে ডলার দর ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় তাদের এখন চড়া মূল্য দিতে হবে।
তিনি বলেন, মুদ্রার বিনিময় হার যেকোনো সময় বেড়ে যেতে পারে, এই বিষয়টি তাদের মাথায় থাকে। এ কারণে লোকাল কারেন্সিতে ঋণ নিলে এসব ঋণ তারা দ্রুত পরিশোধ করার চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে দেখা গেছে, গত বৃহস্পতিবার এক ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোকে গুনতে হয়েছে ১০৬ টাকা ৯০ পয়সা। ব্যাংকগুলো যে দামে ডলার কেনাবেচা করে, সেটিকে আন্তঃব্যাংক দাম বলা হচ্ছে।
এতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে দামে ডলার কেনাবেচা করত, সেটি আন্তঃব্যাংক দর হিসেবে উল্লেখ করা হতো। এতদিন সেই দামই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এক বছর আগে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ২০ পয়সা। খোলাবাজারে ডলার আরো চড়া দামে ১১৪ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে।
এদিকে, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি উৎস থেকে সরকারি-বেসরকারি খাতের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৮১ কোটি (৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন) ডলার। দেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
৫ বছরের ব্যবধানে এই ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। ওই সময়ে দেশে মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে সরকারের পাশাপাশি দেশের বেসরকারি খাতেও বিদেশি ঋণ বেড়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ ছিল ১২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছরে এ ঋণ প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলারে।
বিদেশ থেকে দেশি উদ্যোক্তাদের ঋণ সংগ্রহের সুযোগ দিতে ১৯৮৫ সালে ‘অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট’ নামে ব্যাংকের আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়। বর্তমানে ৩৬টি ব্যাংক এই বিভাগ গঠন করে ঋণ বিতরণ করছে।
প্রথম দিকে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা নিলেও পরে অন্য খাতের উদ্যোক্তারাও এই সুবিধা নিতে শুরু করেন। ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি বিদেশি ঋণ নেওয়ার পথ আরও প্রশস্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে বিদেশি মালিকানাধীন সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানও মূল কোম্পানি (প্যারেন্ট) থেকে ঋণ নিতে পারবে। তবে এ সুবিধা ট্রেডিং ব্যবসার জন্য প্রযোজ্য হবে না। উৎপাদন ও সেবা কার্যক্রম শুরু থেকে ছয় বছর পর্যন্ত নেওয়া যাবে। আগে এই সুবিধা তিন বছর পর্যন্ত নেওয়া যেত।
বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে বড় জোগানদাতা বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে দেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকের শাখাগুলো। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। অন্যদিকে দেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষপর্যায়ে রয়েছে ইস্টার্ন, সিটি, ব্র্যাক, এবি ও ইসলামী ব্যাংক।
অগ্রণী, আল-আরাফাহ, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা, ডাচ্-বাংলা, এক্সিম, আইএফআইসি, যমুনা, মার্কেন্টাইল, মিডল্যান্ড, মধুমতি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, এনসিসি, ওয়ান, প্রিমিয়ার, প্রাইম, পূবালী, শাহজালাল, সোশ্যাল ইসলামী, সাউথইস্ট, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট, ইউসিবি, উত্তরা, সিটি এনএ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অফ সিলন, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া ও উরি ব্যাংকের মাধ্যমেও এ ঋণ দেওয়া হয়।