তসলিমা নাসরিন
১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের মৌলবাদি সরকার মেয়েদের জন্য হিজাব, এবং ঢিলে পোশাক বাধ্যতামূলক করেছে। এর আগে ইরানের কোনও মেয়ে কি হিজাব পরতো না? পরতো। যার ইচ্ছে পরার, পরতো, যার ইচ্ছে না পরার, পরতো না। মেয়েরা সমুদ্রের ধারে বিকিনি পরে রৌদ্রস্নান করতো। মিনিস্কার্ট পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। মোদ্দা কথা, মেয়েদের যে পোশাক পরার ইচ্ছে, তা পরার স্বাধীনতা তাদের ছিল। ইসলামী মৌলবাদিরা ক্ষমতায় আসার পর প্রথম যে কাজটি করলো, তা হলো, মেয়েদের স্বাধীনতা কেড়ে নিল। ইসলামী মৌলবাদিরা যে রাজ্যের বা রাষ্ট্রেরই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, সে রাজ্যে বা রাষ্ট্রেই মেয়েদের স্বাধীনতা এবং অধিকারের কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। মেয়েদের নিতান্তই যৌনবস্তু, পুরুষের দাসী এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশেও মেয়েদের হিজাব পরানোর জোর আয়োজন চলছে। সত্তর দশক বা আশির দশকের বাংলাদেশ এবং এখনকার বাংলাদেশে আকাশ পাতাল পার্থক্য। এখন মেয়েদের শরীর কালো কাপড়ে, এবং হিজাবে, পর্দায় ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। ষাট-সত্তর-আশির দশকে কি বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক ছিল না? ছিল। এখন যত ধার্মিক, তার চেয়ে নেহাত কম ছিল না। তাহলে কী এমন ঘটেছে যে মেয়েদের পোশাকে এমন বিস্তর পরিবর্তন আনতে হয়েছে? কেন মেয়েদের পোশাকে ধর্ম বহন করতে হচ্ছে? হচ্ছে, কারণ এখনকার ইসলামটি ধর্মীয় ইসলাম নয়, এখনকার ইসলামটি রাজনৈতিক ইসলাম। মসজিদে মাদ্রাসায় ওয়াজে যে ইসলামটির প্রচার হয়, তা ধর্ম নয়, পুরোটাই রাজনীতি। ক্ষমতা দখল করার রাজনীতি। ক্ষমতা দখল করার ইচ্ছে মৌলবাদিদের প্রচ-, তারা তাদের ইচ্ছের ঝান্ডা উড়িয়ে দিয়েছে, সেই ঝান্ডাই হলো মেয়েদের বোরখা, মেয়েদের নিকাব, মেয়েদের হিজাব, মেয়েদের ফুলহাতা জামা বা ব্লাউজ। এখন মৌলবাদিরা বলে বেড়াচ্ছে, হিজাব হচ্ছে ‘চয়েজ’। ক্ষমতার ওঠার সিঁড়ি বেয়ে যত তারা ওপরে উঠবে, অথবা ক্ষমতাসীন দুর্বল সরকারকে যতই তারা নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাবে, ততই তারা হিজাবকে আর ‘চয়েজ’ বলবে না, হিজাবকে ‘বাধ্যতামূলক’ করবে। ইরানে যা হয়েছে। শিয়া সুন্নিতে বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু তাদের মৌলবাদি চরিত্রে কোনও বিরোধ নেই। দুই সম্প্রদায়ের টার্গেট নারী। নারীকে তারা পরাজিত করবে, নারীর শিক্ষায় বাদ সাধবে, নারীকে স্বনির্ভর হতে দেবে না, নারীকে তার আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে দেবে না। নারী যেন নরকের কীট, নারীর শরীর থেকে যেন দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, নারীর শরীরে যেন জগতের সমস্ত পাপ বাসা বেঁধেছে, তাই নারীর আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে হবে। নারীরা তাদের শরীর নিয়ে জনসম্মুখে আসার যোগ্য নয়। তাদের লুকিয়ে থাকতে হবে বস্তার মধ্যে। তাদের চুল যেন আলো বাতাস পাওয়ার যোগ্য নয়। পুরুষের যৌন ইচ্ছে জাগরিত হবে নারীর চুল দেখলে, সে কারণে নারীকে তার চুল আড়াল করতে হবে। নারীর বাহু দেখলে, পা দেখলে পুরুষ লোভ করবে, তাই নারীকে তার হাত পা ঢেকে রাখতে হবে। সপ্তম শতাব্দিতে যে কারণ দেখিয়ে নারীকে আবৃত করা হতো, একবিংশ শতাব্দির বিজ্ঞানসমৃদ্ধ সভ্য পৃথিবীতে একই কারণ দেখিয়ে নারীকে আবৃত করা হচ্ছে। ছলে বলে কৌশলে যত মেয়েদের হিজাব পরাতে পারবে মৌলবাদিরা, তত তাদের সামাজিক জয় নিশ্চিত হবে। সামাজিক জয় হাতে এলে রাজনৈতিক জয় সহজ হয়ে ওঠে। নারীরা মৌলবাদিদের রাজনৈতিক জয়ের সিঁড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। রাজনৈতিক জয় পেয়ে গেলে দেশের সর্বনাশ করবে তারা। ধর্মনিরপেক্ষতাকে দূর করবে, অমুসলিমদের বিদেয় করবে, নারীর শিক্ষা, স্বাধীনতা আর স্বনির্ভরতাকে চিরকালের জন্য কবর দিয়ে দেবে। ইরানে, আফগানিস্তানে, সৌদি আরবে কী ঘটেছে, কী ঘটছে, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
“আল্লাহতায়ালা মেয়েদের মাথায় যে চুল দিয়েছেন, তা লুকিয়ে রাখা মানে আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিকে অস্বীকার করা। যদি মেয়েদের চুলে সমস্যা থাকতো, তাহলে চুল ছাড়াই তিনি মেয়েদের পয়দা করতেন। শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ভুল ধরা মানে আল্লাহর সৃষ্টিকে ভুল ধরা। সৃষ্টিকে পুজো করলে স্রষ্টাকে পুজো করা হয়।’’ এক ধার্মিক সেদিন বললেন আমাকে। এমন ধার্মিকের সংখ্যা বাংলাদেশে কমে গেছে। এখন রাজনৈতিক ধার্মিকের সংখ্যা বাড়ছে। ওয়াজীরা সামিয়ানা টাঙিয়ে চিৎকার করে যেসব বক্তৃতা দেয়, সেসব ধর্মের বক্তৃতা নয়, সেসব ধর্মকে ব্যবহার করা রাজনৈতিক বক্তৃতা। ধর্মের জন্য বক্তৃতার প্রয়োজন হয় না। যার ধর্ম সে পালন করবে, যে যেভাবে পালন করতে চায়, সে সেভাবে করবে। ধর্ম যদি মানুষকে এই অধিকার না দেয়, তবে সেটি আর ধর্ম নয়।
ইরানের মেয়েরা বহু বছর যাবৎ বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে লড়ছে। কয়েক বছর আগে এক মেয়ে রাস্তার পাশে রাখা ইউটিলিটি বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে মাথা থেকে তার সাদা স্কার্ফটি খুলে একটি লাঠির মাথায় স্কার্ফটি নিয়ে জনবহুল রাস্তার জনতাকে দেখিয়ে লাঠিটি নেড়েছিল। এই ছবিটি প্রচারিত হওয়ার পর ইরানের বিভিন্ন শহরের মেয়েরা একই কাজ করেছে। রাস্তার ইউটিলিটি বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে লাঠির মাথায় সাদা হিজাব নিয়ে নাড়িয়েছে। মসজিদের গম্বুজে উঠেও কিছু মেয়ে মাথার হিজাব খুলে নাড়িয়েছে। এই নাড়ানো মানে বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের মাধ্যমে তারা একটি কথাই বলতে চায়, যারা হিজাব পরতে আগ্রহী, তারা হিজাব পরবে, যারা পরতে চায় না, তারা পরবে না। কিন্তু মৌলবাদি রাষ্ট্র মেয়েদের হিজাব না পরার অধিকার দিতে রাজি নয়। প্রতিবাদী নারীদের এক এক করে গ্রেফতার করেছে, অত্যাচার করেছে, জেলে ভরেছে। মাশা আমিনী নামের এক বাইশ বছরের মেয়ের হিজাব পরায় কিছু ভুল ধরেছে ধর্মীয় নীতি-পুলিশ। মাশার হিজাবের দৈর্ঘ্য নাকি কম ছিল। মাশাকে গ্রেফতার করে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে তারা। এই খবর প্রচার হওয়ার পর ইরানের রাস্তায় হাজার হাজার নারী পুরুষ বেরিয়ে পড়েছে, বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে আবারও সরব হয়েছে। সারা পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ইরানের হিজাব-বিরোধী প্রতিবাদকে সমর্থন জানিয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইরানের প্রতিবাদী মেয়েরা মিছিলে তাদের হিজাব খুলে শূন্যে উড়িয়েছে। কেউ কেউ তো জনসম্মুখে তাদের হিজাব আগুনে পুড়িয়ে প্রতিবাদ করেছে। কেউ কেউ নিজের চুল কেটে প্রতিবাদ করেছে।
বাংলাদেশে যারা হিজাবের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, তাদের কিন্তু ইরানের মেয়েদের দিকে দেখা দরকার। হিজাব না পরলে বা হিজাব পরায় একটু এদিক ওদিকে হলেই বা চুল দৃশ্যমান হলেই মেয়েদের গ্রেফতার করা হয়, থানায় নিয়ে তাদের অকথ্য অত্যাচার করা হয়, তাদের প্রচুর টাকা জরিমানা দিতে হয়, জেল খাটতে হয়। বাংলাদেশে মৌলবাদের যে উত্থান শুরু হয়েছে, এবং মেয়েরা হিজাব বোরখা পরে মৌলবাদিদের রাজনৈতিক ইসলামের পথ যেভাবে সুগম করছে, তাতে কিন্তু বাংলাদেশে ইরানের অবস্থা আসতে খুব বেশি দেরি নেই। মৌলবাদিরা মাদ্রাসার মেয়েদের হিজাব বা বোরখা পরাতে বাধ্য করে। এবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হিজাব পরতে বাধ্য করতে আদাজল খেয়ে লেগেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবাধিকারের আন্দোলন যুগ যুগ ধরে হচ্ছে, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, প্রখ্যাত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে, প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের পীঠস্থানকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মে মুড়িয়ে দেওয়া হলে রাজনৈতিক ইসলামের জয়জয়কার পড়ে যাবে। প্রতিটি মেয়েকে হিজাব পরাতে বাধ্য করাই মৌলবাদিদের গভীর ষড়যন্ত্র। তাদের এই ষড়যন্ত্র সফল হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ফুটবল দলের মেয়েরা মাঠজুড়ে হিজাব ছাড়া, ওড়না ছাড়া, পাজামা ছাড়া সাফের চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। মৌলবাদিরা কিন্তু দেশের মুখ অন্ধকারই চিরকাল করেছে, কোনও দিন উজ্জ্বল করেনি। হিজাববিহীন মেয়েরাই বরং উজ্জ্বল করেছে। সুতরাং দেশের সরকারের দায়িত্ব মানবাধিকার বিরোধী, বাক স্বাধীনতা বিরোধী, নারীবিদ্বেষী মৌলবাদিদের নয়, বরং গুণী মেয়েদের কদর করা। এই মেয়েরাই দেশের সম্পদ। ছেলে-ফুটবলারদের পেছনে যে টাকা পয়সা খরচ করা হয়, মেয়ে-ফুটবলারদের পেছনে তার অর্ধেকও খরচ করা হয় না। মনে রাখতে হবে নারীই জাতির ভবিষ্যৎ। নারীকে দাবিয়ে না রেখে, তাদের বস্তাবন্দি, ঘরবন্দি না করে তাদের স্বাধীনতা আর অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে তাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া হোক, তারা শুধু নিজেরা সমৃদ্ধ হবে না, তারা সমাজকে এবং রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করবে। মেয়েদের উন্নতির পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে চূড়ান্ত অপশক্তি ধর্মীয় রাজনীতি। মেয়েদের পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলার দায়িত্ব দেশের সকল শুভানুধ্যায়ীর, সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সরকারের।