মিয়ানমারের দুটি জঙ্গি বিমান গত শুক্রবার রাত ১১টার দিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো লাইনের কাছাকাছি এসে বোমা ও গুলি বর্ষণ করেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, রাতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে সীমান্তের পাহাড়ের দিকে গোলা ছোড়া হয়। এতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সূত্র জানায়, রাত সাড়ে ১০টার পর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকার বাজার পাড়ার লোকজন যুদ্ধবিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ দেখতে পান। এ ছাড়া গতকাল সকালেও থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান তুমব্রুর বাসিন্দারা। তুমব্রু বাজারের ব্যবসায়ী বদিউল আলম জানান, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের এপারে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার নম্বর ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ এলাকার ওপর দিয়ে ফাইটার বিমান দুটি উড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘বিমান থেকে বোমাবর্ষণের আওয়াজ এবং এর আলো আমি দেখেছি। তবে ঠিক কোথায় বোমা পড়েছে তা জানি না।’ তুমব্রু সীমান্তের উত্তর পাড়া এলাকার এসএসসি পরীক্ষার্থী অং প্রু তঞ্চঙ্গ্যা জানান, তারা ভয়ে ভয়ে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজে তারা পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারছেন না। নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মংলাওয়াই মার্মা জানান, ‘শনিবার রাতে তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের যুদ্ধ বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপের দৃশ্য দেখা গেছে। এর কিছুক্ষণ পর পরই বিকট শব্দে সীমান্ত এলাকা কেঁপে ওঠে।’ সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয় ও রোহিঙ্গারা জানান, রাতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু-মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিমান দেখা গেছে। সে সময় তাদের যুদ্ধবিমান থেকে প্রায় ৩-৫টি গোলা ছোড়া হয়। তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা মাহামুদুল হক জানান, গতকাল সকালে দু-একবার গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। এতে এখানকার মানুষজন ভয়ভীতির মধ্য রয়েছেন। এদিকে বিজিবি জানায়, স্থানীয় লোকজন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে যাওয়ার দাবি করলেও দুটি ফাইটার বিমান সীমান্তের জিরো লাইনের কাছাকাছি উড়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি। বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মো. মেহেদী হাসান কবির সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং আকাশসীমার ওপর বিজিবির নজরদারি রয়েছে। এ বিষয়ে কোনো ধরনের আতঙ্ক না ছড়াতে তিনি অনুরোধ জানান। স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, মিয়ানমারের সরকারবিরোধী গেরিলা গ্রুপ আরাকান আর্মি (এএ) ৩৪ ও ৩৫ নম্বর আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার থেকে ৩৭, ৩৮ এবং ৩৯ নম্বর এর দিকে সরে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের লক্ষ্য করেই মিয়ানমার সরকারি বাহিনী বোমা নিক্ষেপ করেছে।
ঘুম ভাঙে গোলার শব্দে : নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের মিয়ানমারের ওপারে গত দেড় মাস ধরে আরকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যেই চলছে। দুই পক্ষের যুদ্ধের কারণে সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসকারী লোকজনের মাঝে অজানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া মানুষরা সব সময় ভয়ে থাকছেন। তুমব্রু-ঘুমধুম ছাড়া ও এক সপ্তাহ জুড়ে উখিয়ার সীমান্তবর্তী পালংখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টের ওপারে গোলাগুলি চলছে বলে স্থানীয় বাসিন্দা আবু শমা জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের নতুন ফাঁদ বলে অনেক রোহিঙ্গারা জানান। তুমব্রু কোনার পাড়া সংলগ্ন জিরো পয়েন্টের কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। তুমব্রু জিরো পয়েন্টে থাকা রোহিঙ্গা মোহাম্মদ সাদেক মিয়া বলেন, মিয়ানমারের ওপারে প্রতিদিন গোলাগুলি চলছে। রাত হলে আতঙ্ক বাড়ে। সে কারণে কিছু কিছু রোহিঙ্গা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে চলে যাচ্ছেন। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়িযোগে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। গতকাল দেড়টার দিকে তুমব্রু থেকে একটি ইজিবাইক উখিয়ার বালুখালীর দিকে যাচ্ছিল। এ সময় বিজিবি সদস্যরা গাড়ি তল্লাশি করার সময় ৫ রোহিঙ্গা দৌড়ে পালিয়ে যায়। বিজিবির এক সদস্য বলেন, এরা উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যাচ্ছে। সে কারণে সীমান্তে মোড়ে মোড়ে চৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সীমান্তঘেঁষা তুমব্রু পশ্চিম পাড়া বাসিন্দা আবদুল জব্বার (৩৫) বলেন, ঘুমধুম তুমব্রু এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজ ও টমটম (ইজিবাইক) সিএনজি গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। সীমান্ত এলাকায় দেড় মাস ধরে চলমান মর্টার শেল ও হেলিকপ্টার এবং যুদ্ধ বিমান থেকে ছোড়া গোলা ও ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দে কাজকর্ম করা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বিগত সময় তাদের ছোড়া মর্টার শেলের গোলা ও ভারী অস্ত্রের গুলি আমাদের এলাকায় এসে পড়েছে। আমাদের ছেলে মেয়েরা ভয়ে স্কুলে যেতে পারে না। তিনি আরও বলেন, শুক্রবার রাতে সাড়ে ১০টার দিকে তুমব্রু সীমান্তের কাছাকাছি মংডু থানার ঢেকিইবনিয়া, মেদায়, সাম্বালাসহ বেশ কিছু গ্রামে ড্রোন ব্যবহার করে বিমান হামলা চালানো হয়েছে। সীমান্তের ওপারে মাইন বসিয়ে রাখা হয়েছে। এ হামলা বন্ধ না হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হবে এবং নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা থাকবে।