সম্প্রতি হালদা নদীতে মা মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যুসহ নানা কারণে বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছে হালদা। এ নদীর পরিবেশ এখনও ইতিবাচক বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরীয়া। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীর তানিম
পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র বলা হয় হালদাকে। এই হালদা বিভিন্ন সংকটে জরাজীর্ণ। সংকট নিরসনে আপনাদের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
বাংলাদেশ নামে ভূখণ্ড তৈরি হয়েছে নদী থেকে। কিন্তু সেই অর্থে নদীর তেমন মূল্যায়ন হয়নি। হালদা প্রসঙ্গে যদি আসি, এটি আমাদের নিজস্ব নদী। দেশের মধ্যে উৎপত্তি, দেশেই সীমাবদ্ধ। আবার এর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা শুধু বাংলাদেশে নয়; সারাবিশ্বেই অনন্য। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী, বিভিন্ন সংকটে জরাজীর্ণ। আমি যখন শুরু করি তখন আরও বেশি ছিল। আশার কথা হচ্ছে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে একটা নদীকে নিয়ে কোনো অর্জন, পরিবেশগত উন্নয়ন যদি বলি, এর কিছুটা হালদার আছে। তারপরও পরিপূর্ণভাবে আমরা সে পথে যেতে পারিনি। এর প্রধান কারণ দূষণ। আগে আরও বেশি ছিল। বর্তমানে এশিয়ান পেপার মিল, হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্লান্ট প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ। মানিকছড়ি এলাকায় আগে প্রচুর তামাক চাষ হতো, তামাকচাষিদের মূলধারার কৃষিতে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি আমরা। শুধু সিটি করপোরেশনের কিছু বর্জ্য এখনও হালদাতে পড়ছে। এটা যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, হালদা বাংলাদেশে একটা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
দূষণ তো একমাত্র সংকট নয়।
জি, অবশ্যই। যেহেতু ব্রুড ফিশের (মা মাছ) ডিম ছাড়ার নদী এটি। এখানে বড় বড় ১৪-১৮ কেজির মাছ আছে। এই মাছের লোভ অনেকেই সামলাতে পারে না। রাতের অন্ধকারে স্থানীয়দের সঙ্গে আগে আমরা পাহারা দিয়েছি। এখন স্থানীয় প্রশাসন, নৌ-পুলিশ, এনজিও কর্মীরা রীতিমতো যুদ্ধ করছেন। এ ক্ষেত্রেও আমাদের অনেক সফলতা আছে। আমরা এনজিও আইডিএফ ও পিকেএসএফের সহায়তায় ৪০ জন ভলান্টিয়ার নিয়োগ করেছি। তাঁরা হালদাতে পাহারা দিচ্ছেন।
এর পরের বিষয়টি হলো, অপরিকল্পিত উন্নয়ন। হালদার দুই পাশে যে শাখা নদী আছে, সেগুলো পানিপ্রবাহে ভূমিকা রাখে। এই নদীগুলোকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে হালদাতে ব্লক ফেলা হয়েছে এবং জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়েছে। এভাবে হালদাকে নানা সংকটের মুখোমুখি করা হয়েছে।
বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন নেওয়া হচ্ছে, সংকটের পাল্লাও ভারী হচ্ছে। উদ্যোগগুলো ফলপ্রসূ হচ্ছে না কেন?
তথ্যটি আসলে সঠিক নয়। আগে আরও বেশি মাছ ধরা হতো। আগে ডলফিন একটা মারা গেলে কেউ এসবের খবর রাখেনি। এখন একটা ডলফিন মারা গেলে খবর হয়ে যায়। একটা সময় হালদাতে অহরহ মাছ ধরা হতো। এখন একটা মাছ ধরলেও খবর হয়। আগে মানুষ সচেতন ছিল না, মিডিয়া গুরুত্ব দেয়নি। এখন সবাই কম-বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
হালদা রক্ষায় প্রশাসনের ভূমিকা কি যথেষ্ট?
প্রশাসনের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সমস্যা অনুযায়ী অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আগে জাল দিয়ে স্বাধীনভাবে সারাদিন মাছ ধরা হতো। এখন জাল যখন আটকা পড়েছে, বিকল্প উপায় হিসেবে বিষ ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে প্রতিনিয়ত কৌশল পরিবর্তন করছে দুর্বৃত্তরা।
সম্প্রতি কয়েকটি ব্রুড ফিশ মারা গেল। মাছগুলো কীভাবে মারা গেছে বলে আপনার মনে হয়?
যে মাছগুলো মারা গেছে, এর একটি এখনও এখানে আছে। বাহ্যিক অংশ পর্যবেক্ষণ করে যা মনে হলো, মাছ চোরেরা রাতের অন্ধকারে, ভাটার সময় যখন পানি কমে আসে তখন হয়তো কোনো একটা মাছের আবাসস্থলে বিষ প্রয়োগ করেছে। আগে জাল দিয়ে মাছ ধরা হতো, সেটা প্রতিহত করেছি। এখন বিষ প্রয়োগ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার চিন্তাভাবনা- আমাদের সঙ্গে স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যানকে যুক্ত করতে হবে। তাঁদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যে ৪০ জন ভলান্টিয়ারকে আমরা বলে দিয়েছি কারা কারা বিষ প্রয়োগের সঙ্গে জড়িত তাদের তালিকা করতে।
আপনি একজন হালদা গবেষক। গবেষণায় কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কি?
সীমাবদ্ধতা অবশ্যই আছে। আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট নেই, ম্যানপাওয়ার নেই। এমনকি হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিটিও পিকেএসএফ, আইডিএফের সহযোগিতায় তৈরি। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আছে। সব নিজ থেকে করতে হয়।
ডলফিন রক্ষায় আপনারা কী ভাবছেন?
প্রথমত, ডলফিন সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসককে প্রধান করে হাইকোর্ট থেকে একটা কমিটি করা হয়েছে। আমি সেখানে সদস্য। এগুলোর জন্য স্থানীয় মানুষ যারা আছে, তাদের সচেতন করতে হবে- এটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, ডলফিন থাকলে হালদার অস্তিত্ব থাকবে, মা মাছ থাকবে। ডলফিন যেদিন থাকবে না, সেদিন মাছের প্রজননও থাকবে না। সেজন্য যে কোনো মূল্যে ডলফিন সংরক্ষণ করতে হবে। ডলফিন যেহেতু আলাদা মন্ত্রণালয়ের সম্পদ। আমি মনে করি, হালদাকে ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমান পরিস্থিতিটাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। সমস্যা থাকবে। সম্মিলিতভাবে তা উত্তরণ করতে হবে।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।