ওড়িশার গ্রাম রঘুরাজপুর। গ্রামের প্রতিটি পরিবার বংশপরম্পরায় আঁকে পটচিত্র। সেই গ্রামই হাজির হচ্ছে পুজোর কলকাতায়। সৌজন্যে, উল্টোডাঙার অরবিন্দ সেতু সর্বজনীন।শুধু রঘুরাজপুরের পরিবারগুলির ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যাওয়ার রীতিই নয়, কোথাও একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা, আবার কোথাও পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া বই এবং গল্পকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস— এ বারের পুজোয় কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ সেজে উঠছে এমন নানা বিষয়ের উপরে ভিত্তি করে।
অরবিন্দ সেতু সর্বজনীনের থিমের নাম ‘বহন’। রঘুরাজপুর গ্রামে ২০-২২টি পরিবারের বাস। হেরিটেজ তকমা পাওয়া ওই গ্রামে পরিবারের সকলেই পটচিত্র আঁকায় অংশ নেন। সেটাই তাঁদের জীবিকা। কোনও রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই শিল্পকে ‘বহন’ করে নিয়ে চলেছে পরিবারগুলি। পুজোর মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর মিন্টু পাত্র বলেন, ‘‘এ বারের পুজোয় এক টুকরো রঘুরাজপুর গ্রাম তুলে ধরছি আমরা। এই পরিবারগুলির কাজ শিল্পের মর্যাদা পাক, এটাই আমরা চাই।’’ পুজোর শিল্পী মধুরিমা পাল। তিনি জানান, ওই গ্রামের বাড়ির আদলে মণ্ডপটি গড়ে তোলা হচ্ছে। মণ্ডপ চত্বর সাজানো হবে রঘুরাজপুর গ্রামের শিল্পীদের আঁকা পটচিত্র দিয়ে। ফাইবারের মূর্তির মাধ্যমে বংশপরম্পরায় কাজ শেখানোর দিকটি তুলে ধরা হবে।
এখন আর দেখা মেলে না একান্নবর্তী পরিবারের। টুকরো টুকরো হয়ে পরিবারের সদস্যেরা ছড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। পরিবারের সকলে আবার যাতে এক হাঁড়ির অন্ন খেতে পারেন, সেই প্রার্থনা নিয়েই এ বার মাতৃ আরাধনায় মেতেছে ৬৬ পল্লি। তাদের থিম ‘এক-অন্ন-বর্তী’। পুজো কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রদ্যুম্ন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যৌথ পরিবােরর ভেঙে যাওয়াটা একটি সামাজিক ব্যাধি। এতে শুধু পরিবার ভাঙে না, বাচ্চাদের শৈশব হারিয়ে যায়, ভেঙে যায় অনেক জীবনও।’’ একটি পরিবারের দুর্গামন্দির হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে মণ্ডপ। যে বাড়ির দুর্গামন্দির হিসাবে মণ্ডপ গড়ে তোলা হচ্ছে, সেই বাড়িটি অবশ্য আসল। মণ্ডপের পাশেই এলাকার ওই বাড়িটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার চিত্র। দেখানো হবে বাড়ির একটি দিক চাকচিক্যময়। ভেঙে পড়ছে অন্য দিকটি। পুরো বিষয়টি ভেবেছেন শিল্পী পূর্ণেন্দু দে।
পুজোয় নারী-সুরক্ষা নিয়েও কাজ করছে ৬৬ পল্লি। প্রদ্যুম্ন জানান, পুজোর পরে ছ’মাস ধরে কলকাতার প্রায় পাঁচ হাজার মেয়েকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো হবে। স্কুল বা কলেজ কর্তৃপক্ষ চাইলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েও এই প্রশিক্ষণ তাঁরা দেবেন। ‘দুর্গতিনাশিনী’ নামে এই উদ্যোগের সূচনা হবে চতুর্থীর দিন। প্রশিক্ষণ দেবেন মার্শাল আর্টস প্রশিক্ষক গৌরব গোস্বামী। তিনি বলেন, ‘‘এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এমন উদ্যোগ আরও বেশি করে হওয়া উচিত।’’
শিশুদের মধ্যে কমেছে বই পড়ার অভ্যাস। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার কারণে দাদু-দিদিমার কাছ থেকেও নেই গল্প শোনার সুযোগ। ফলে বাচ্চাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গল্প। যা শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ বারের পুজোয় বাচ্চাদের জীবনে সেই গল্পের বইকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছে ভবানীপুরের ‘অবসর’। থিমের নাম ‘অবসর এ বার পুরোটাই গল্প’। এই গল্প খোঁজার দায়িত্বে দ্বৈপায়ন দাস, প্রিয়াঙ্কা জানা, পূজা মাইতি— এই তিন সদস্যের শিল্প গোষ্ঠী ‘ত্রয়ী’। পুজো মণ্ডপের মূল ফটক হবে একটি খোলা বই। মণ্ডপের ভিতরে দেখানো হবে গল্পগুলি বইয়ের থেকে বেরিয়ে আসছে। দুর্গা বই পড়ছেন। প্রিয়াঙ্কার কথায়, ‘‘যেন বই পড়ে গল্প শোনানোর দায়িত্ব দুর্গাই নিয়েছেন।’’