দেশে মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার হচ্ছে ১৮ কোটি ৪০ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে মোবাইল ফোন ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে ১১ কোটি ৬৪ লাখ সংযোগে। কেউ ৯০ দিনে একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করলে তাকে ইন্টারনেট গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। স্মার্টফোন ক্রয় করতে না পারা ও ডিজিটাল জ্ঞানের অভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
মোবাইল ফোন সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট সেলুলার ফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ৪১ শতাংশ। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা নারীর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, স্মার্টফোন ব্যবহারে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশে পিছিয়ে আছে। এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে একটি মোবাইল ফোন কিনতে বেশি কর দিতে হয়। এতে অনেক মানুষের পক্ষেই স্মার্টফোন কেনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যবসায়িক পর্যায়ে মোবাইল ফোনের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে সরকার। সেই ভ্যাট ক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে। এই ভ্যাট আরোপের পর দেশে স্মার্টফোন বিক্রি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে কমেছে।
২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব ও কার্যকর নীতি প্রণয়নে পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে ডিজিটাল বিভাজন (ডিজিটাল ডিভাইড) কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে ব্রডব্যান্ড কমিশন নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি স্মার্টফোনের সর্বজনীন ব্যবহার নিয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর ‘স্ট্র্যাটেজিস টুয়ার্ডস ইউনিভার্সাল স্মার্টফোন অ্যাকসেস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোবাইল ফোন থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। এছাড়া ২৬ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজনই মনে করেন না, সামর্থ্য না থাকায় ব্যবহার করেন না ১১ শতাংশ, সুযোগ না থাকায় ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না- এমন মানুষের সংখ্যা ১৭ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ মানুষ নিরাপত্তাজনিত কারণে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না।
ব্রডব্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ থ্রিজি নেটওয়ার্ক সুবিধার আওতায় এসেছেন। উন্নত দেশগুলোতে এটা ৯৯ শতাংশ হলেও নিম্ন আয়ের দেশে এই হার ৮৬। তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ (২৭০ কোটি) এখনো ইন্টারনেটে যুক্ত নন। এর মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ ভালো ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সুবিধার আওতায় বাস করেন। তা সত্ত্বেও অনেক মানুষ এই সুবিধা নিচ্ছেন না।
ব্রন্ডব্যান্ড কমিশন বলেছে, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর্থসামাজিক অবস্থান আগের চেয়ে অন্তত ৩ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এই আর্থসামাজিক অবস্থানের উন্নতি ৪ থেকে ৬ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন এমন ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিশ্বে ৯৪ শতাংশ মানুষের মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও ৫১ শতাংশ মানুষ তা ব্যবহার করছেন। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে তা আরো বেশি। এ অঞ্চলের দেশগুলোতে গড়ে ৯৫ শতাংশ মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আছে, কিন্তু ব্যবহার করেন ৩৪ শতাংশ।
এদিকে জাতিসংঘের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) হিসেবে বিশ্বে গড়ে ৮৫ শতাংশ মানুষ ফোর-জি নেটওয়ার্ক সুবিধার আওতায় এসেছেন। কিন্তু ফোর-জি ব্যবহার করেন ৫৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে পিছিয়ে দক্ষিণ এশিয়া। এ অঞ্চলের দেশগুলোর ৭৮ শতাংশ মানুষ ফোর-জি নেটওয়ার্ক সুবিধার আওতায় এসেছেন। কিন্তু ফোর-জি ব্যবহার করেন ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ সুযোগ থাকলেও অনেকেই ফোর-জি ব্যবহার করছেন না।
উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহারে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এ নিয়ে জিএসএমএর ১৬০টি দেশকে নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইন্টারনেটের গতি টু-জি থেকে থ্রি-জিতে উন্নীত হলে একটি দেশের জিডিপি বাড়ে ১৫ শতাংশ এবং টু-জি থেকে ফোর-জি উন্নীত হলে জিডিপি ২৫ শতাংশ বাড়ে।
সেলফোনে ইন্টারনেট ও ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে দেশে মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব)-এর মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এস এম ফরহাদ গণমাধ্যমকে বলেন, উভয় ক্ষেত্রেই জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। স্মার্টফোন কিনতে না পারা বা ব্যবহারের দক্ষতা না থাকাটা যেমন মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার না করার অন্যতম কারণ তেমনি এই ইন্টারনেট কী কাজে আসবে, সেটা বুঝতে না পারাও একটা বড় কারণ। এর জন্য জ্ঞানের অভাব ও মানুষের আর্থিক অবস্থাও দায়ী। এছাড়া আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে এবং শিক্ষিত- এমন অনেকেই আছেন, যারা বয়সের কারণে বা নিরাপত্তার কারণে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। তাই ফোর-জির আওতায় থেকেও শুধু সচেতনতার অভাবে বাংলাদেশে অনেকেই মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না।