দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। জেলাপর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ডও কমিশন পর্যবেক্ষণে রাখবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাদের ভোটের সময় ইসির নির্দেশনা মেনে চলার কথা বলা হয়েছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে শনিবার (৮ অক্টোবর) সব জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সিইসি এই পরামর্শ দেন। এ সভায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তার অশ্বাস দেয়া হয়। সভায় নির্বাচন কমিশনার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরে ইসির মিডিয়া সেন্টারে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন বিষয়ে কর্মকর্তাদের আচরণে এমন কিছু যাতে প্রতিফলন না হয়-যাতে জনগণ ভাবতে পারেন আপনারা একটি দলের পক্ষে কাজ করছেন সে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। সেসঙ্গে তাদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছি দলনিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে হবে। এমন কাজ করা যাবে না যাতে জনগণ মনে করে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছেন। নির্বাচনের সময় ইসির অবস্থান থাকবে কঠোর। মাঠ কর্মকর্তাদের কাজও পযবেক্ষণ করা হবে। দায়িত্ব পালনে কোনো শৈথিল্য সহ্য করা হবে না। ইসি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন ও ক্ষমতা প্রয়োগে কঠোর অবস্থানে থাকবে।
রাজনৈতিক দলের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সিইসি বলেন, সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও ইসির প্রতি আস্থা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিভাজন থাকলেও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতে হবে। সংসদ নির্বাচন নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন নিয়ে সংশয় থাকলেও আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট সব দল, পক্ষ তাদের সদিচ্ছা, প্রজ্ঞা যে কোনো সংকট-সংশয় নিরসনে সামর্থ্য রাখে। মতৈক্য ও সমঝোতা হবে; সংশয় ও সংকট কেটে যাবে। ইভিএম নিয়ে তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে আলোচনা এলেও কর্মকর্তাদের এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর পরামর্শ দিয়েছি।
ভোটকেন্দ্র বাড়ানোর বিষয়ে সিইসি বলেন, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা, ভোটারদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ভোটকেন্দ্র বাড়লেও পাশাপাশি ভোটকক্ষ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে বৈঠকে। ভোটের এখনো এক বছর দুই মাসের বেশি সময় বাকি। এ সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠেয় সব নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা হবে। আমরা কঠোর ভাষায় বলছি ভয়ভীতি, পক্ষপাতিত্ব, চাপ বা অন্য যে কোনো কারণে নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপ প্রতিহত করতে না পারলে নির্বাচন হবে না; প্রহসন হবে। পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আপনাদের জবাবদিহি করতে হবে। এতে সংসদ নির্বাচনে জনগণের আগ্রহ, আস্থা ও অংশগ্রহণ উৎসাহিত হবে বলে উল্লেখ করেন সিইসি।
মন্ত্রী-এমপির প্রভাব এবং গুজব নিয়ন্ত্রণ : সভায় নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান লিখিত বক্তব্যে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পক্ষ বা বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের গুজব বা অপপ্রচার ছড়ায় এবং অনেক মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে। আপনারা এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। কোন গুজবের সন্ধান পেলে বা এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে আপনারা দ্রুত গুজবকারীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। এগুলো ছড়ানো হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করবেন।
নির্বাচনের সময় অনেক প্রভাবশালী মহল বা রাজনৈতিক দলের নেতা, সাবেক/বর্তমান মন্ত্রী-এমপিসহ নানা মানুষ এলাকায় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে বিষয়টি তুলে ধরেন এ নির্বাচন কমিশনার।
আহসান হাবিব বলেন, কেউ কেউ নির্বাচনের সময় অনেকে পেশি শক্তি, অর্থশক্তি বা ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করে। কালো টাকার ব্যবহারের কথাও শোনা যায়। আপনারা চোখ-কান খোলা রেখে এই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করবেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা না থাকলে কখনোই সুন্দর-সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
ইসির নির্দেশনা মেনে চলব, হয়রানির সুযোগ নেই : সভা শেষে ইসির মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন বলেন, জেলা পরিষদ ও সংসদ নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে যে নির্বাচনগুলো হবে তা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের বিষয়ে আলাপ হয়েছে। ডিসি-এসপিরা পরামর্শ দিয়েছেন। তারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।
সিনিয়র সচিব জানান, গত নির্বাচনে ৪০ হাজারের মতো ভোটকেন্দ্র ছিল। আগামী নির্বাচনে এ ভোটকেন্দ্র বেড়ে প্রায় ৪৩ হাজারের উপরে হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের যে সংখ্যা তাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা যায় না।
এজন্য আমরা চাচ্ছি ভোট ভেন্যুর সংখ্যা কমিয়ে বুথ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এখন যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। কাজেই ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে যৌক্তিক সংখ্যক করা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা সম্ভবপর হবে। কোনো রকমের পক্ষপাতমূলক আচরণ যেন না হয় সে বিষয়ে ‘এনশিউর’ করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, হয়রানিমূলক মামলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে হয়রানিমূলক মামলার সুযোগ নেই। এর প্রশ্নই নেই। তিনি বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠ প্রশাসনে রদবদল হয় না। এটি রুটিন ওয়ার্ক। কিছুদিন আগে পদোন্নতির কারণে আমরা ৪০টি জেলায় নতুন এসপি নিয়োগ দিয়েছি। ওই এসপিদের আমরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলেছি।
পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি বলেন, নির্বাচনের সময় ইসির অধীনে পুলিশ প্রশাসন কাজ করে থাকে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার আলোকে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। কারো বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জ্বালানি ও ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে আপত্তি, হইচই : বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, জ্বালানি খরচ ও নির্বাহী হাকিমদের ভাতা বাড়ানোর সুপারিশ হলে উষ্মা প্রকাশ করেন নির্বাচন কমিশনার আনিসুর রহমান। একই সঙ্গে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি আচরণবিধি প্রতিপালনে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করার বিষয়টি তুলে ধরেন। প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে হইচই করতে থাকেন। এক পর্যায়ে এই কমিশনার ডায়াস ছেড়ে নিজ আসনে ফিরে যান। এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সভাশেষে সিইসি ব্রিফিং করেছেন। আর কিছু বলার নেই।