দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জাতীয় পার্টির দুই গ্রুপের অন্তঃকলহ চরমে উঠেছে। একদিকে জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদপত্নী বেগম রওশন এরশাদ। অন্যদিকে জি এম কাদের। দুজনের বিপরীতমুখী অবস্থান ও দ্বন্দ্বে কারণে ভাঙনের কবলে পড়েছে দলটি। ওদিকে আগামী সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সরকারপন্থি নাকি সরকারবিরোধী জোটে থাকবে এই নিয়েও দলীয় নেতৃত্বের মাঝে মতভেদ রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব দলটিকে নতুন কোনো সংকটে ফেলে কি না তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। দলটি আবার ভাঙবে কি না সে প্রশ্ন নতুন করে উঁকি দিলেও দলের বর্তমান সিনিয়র নেতারা চাচ্ছেন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে। তাহলেই দল আগের চেয়েও আরো ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী হবে। জাপা নেতা আশা প্রকাশ করেছেন দলের বর্তমান বিরোধ সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে উভয় পক্ষের নেতাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, দলের বর্তমান পরিস্থিতিতে গতকাল শনিবার সভাপতিমণ্ডলীর সভা ডাকেন জি এম কাদের। সভায় অধিকাংশ নেতা বলেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে দুপক্ষের উত্তাপে শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশ বিরাজ করছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে উদ্ভূত এ পরিস্থিতি কর্মী-সমর্থকদের উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। সাম্প্রতিক টানাপড়েন প্রশ্নে জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, দলে কোণঠাসা হয়ে জি এম কাদেরবিরোধীরা রওশন এরশাদকে ভুল বুঝিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে দলে নিজেদের আবারও প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন রওশনপন্থিরা। জাতীয় পার্টির ভেতরে সর্বশেষ দ্বন্দ্বের পেছনে দলের বর্তমান নেতৃত্বের কারণে কোণঠাসা বোধ করা নেতারা রয়েছেন বলে দলের নীতিনির্ধারণী অংশের অভিযোগ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির একজন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জাপার আজকের বৈঠকে বেশকিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভক্তি থাকবে না। জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ থাকবে। সম্প্রতি যে সংকট তৈরি হয়েছে সেটি নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষকবিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। সেটি করার জন্য একটি কমিটি করে চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুসহ দুই শীর্ষ নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটি সংকট সমাধানে রওশন এরশাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তিনি আরো জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে কেউ রওশন এরশাদকে বিভ্রান্তি করছে কি না বা তাকে জিম্মি করছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া ওই বৈঠকে শেষবারের মতো রওশন এরশাদ ঘোষিত আগামী ২৬ নভেম্বর পার্টি কাউন্সিল বাতিল করার জন্য তাকে অনুরোধ করা হবে। তিনি (রওশন এরশাদ) যদি কাউন্সিলে অনড় থাকেন তাহলে তাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করার ব্যাপারেও মত দেন অনেকে। এজন্য রওশন এরশাদের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রয়াত এরশাদের ভাগিনা পার্টির যুগ্ম মহাসচিব আদেলুর রহমান আদেল এমপিকে। রওশন এরশাদ যদি ফোন না ধরেন সেক্ষেত্রে তার সন্তান সাদ এরশাদের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বৈঠক সূত্র থেকে জানা গেছে।
পার্টির এক প্রেসিডিয়াম ও দলীয় সংসদ সদস্য তার বক্তব্যে বলেন, আমার কাছে মেসেজ আছে সাদ এরশাদ ম্যাডামকে জিম্মি করে রেখেছেন। ঢাকায় অবস্থানরত পার্টি থেকে বহিষ্কৃত কয়েকজনের সমন্বয়ে শাদ ম্যাডামের মোবাইল সিজ করে রেখেছেন। তাদের আস্থাভাজন ছাড়া কাউকে রওশন এরশাদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। সভায় সূত্র থেকে আরো জানা গেছে, সিলেট বিভাগের কয়েকটি জেলাকে কেন্দ্র করে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এ টি ইউ তাজ রহমান এবং আতিকুর রহমান আতিকের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর মধ্যস্থতায় পরে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়।
বৈঠকে জাপার চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের তার বক্তব্যে বলেন, পার্টির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, সে যত বড় বা শক্তিশালী হোক না কেন। দলের মাঝে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমি যেকোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নেব।
এ দিকে বৈঠকে শেষে জাতীয় পার্টি মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভক্তি নেই, জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ। এখন জাতীয় পার্টির কোনো কাউন্সিল হচ্ছে না, জাতীয় পার্টির কাউন্সিলের সময় এখনো হয়নি। কিছু মানুষ একটি কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির নাম ব্যবহার করছে। আসলে ওই কাউন্সিলের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, আমরা ওই কাউন্সিলকে আমলেই নিচ্ছি না। প্রেসিডিয়ামের ৪১ সদস্যের মধ্যে ৩৮ জন এবং ২৬ এমপির মধ্যে ২০ জনই আজ উপস্থিত ছিলেন। যারা আসতে পারেননি, তাদের কেউ বিদেশে অথবা অসুস্থ। আসলে সবাই জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপির নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ আছে। কাউন্সিলেই জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানকে দল পরিচালনার সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই।
এর আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপির সভাপতিত্বে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যদের যৌথসভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আবুল কাশেম, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, গোলাম কিবরিয়া টিপু এমপি, অ্যাডভোকেট শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, ফখরুল ইমাম এমপি, সৈয়দ মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, মীর আবদুস সবুর আসুদ, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, এ টি ইউ তাজ রহমান, সোলায়মান আলম শেঠ, নাসরিন জাহান রতনা এমপি, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি, লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, মো. মিজানুর রহমান, নাজমা আখতার এমপি, আলমগীর সিকদার লোটন, এমরান হোসেন মিয়া, মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল এমপি, লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, মো. জহিরুল ইসলাম জহির, মোস্তফা আল মাহমুদ, মোহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক, জরিুল আলম রুবেল, সংসদ সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা রওশন আরা মান্নান, শেরীফা কাদের, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, নুরুল ইসলাম তালুকদার, পনির উদ্দিন আহমেদ, পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান আহসান আদেলুর রহমান।
সমস্যার শুরু গত ৩১ আগস্ট। দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ হঠাৎ করেই আগামী ২৬ নভেম্বর দলের সম্মেলন ডেকে বসেন। সেটি আবার জানতেন না দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। সেদিনই বিষয়টি স্পষ্ট করেন তার অনুসারী নেতারা। পরদিন জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল বৈঠক করে রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরীকে চিঠি দেন। ১৪ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এরশাদ অনুসারী হিসেবে পরিচিত হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালে দলে রওশন-কাদেরের দ্বন্দ্ব হলেও পরে মীমাংসা হয়ে যায়। এবারও তা-ই হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
রওশনপন্থি এক নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের বসলেই মীমাংসা হয়ে যাবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত সেটাই হবে।’ রওশন চিকিৎসার জন্য এখন দেশের বাইরে। অক্টোবর তার দেশে ফেরার কথা আছে, যদিও তা পিছিয়ে যেতেও পারে। তিনি দেশে এলে দুই নেতাকে এক টেবিলে বসানোর একটি উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। দলের প্রেসিডিয়ামের একজন সদস্য বলেন, ‘আমার মনে হয় না রওশন এরশাদ দলের জন্য ক্ষতিকর কিছু করবেন। তবে তিনি দেশে ফিরলে বিষয়টি বোঝা যাবে। তবে আমি ৮০ শতাংশ মনে করি, ভাবি-দেবরের বিষয়টি মীমাংসা হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যান কঠোর কিছু সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছেন। তার মানে এই নয় যে তিনি আওয়ামী লীগ বিমুখ হয়ে গেছেন। তিনি নির্বাচনবিমুখ হননি। সে হিসেবে তো এখনও জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গেই রয়েছে। যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা না হয় তাহলে মনে হয় এবার সরকারের বাইরেও যেতে পারেন তিনি। রওশনপন্থি নেতারা আগের তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মতোই কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে আগ্রহী।
তবে জাতীয় পার্টির জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সম্প্রতি বলেছেন, তারা বিএনপির সঙ্গে যাবেন এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তবে জাতীয় পার্টি আগামী দিনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট নাও করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ৩০০ আসনে এককভাবে প্রার্থী দেওয়া হবে।
রওশনপন্থি আরেক নেতা বলেন, ‘রওশন এরশাদ সবাইকে নিয়ে কাউন্সিল করতে চেয়েছিলেন। তিনি দেশে এসে যে রাজধানী একটি হোটেলে জি এম কাদেরপন্থিদের ডাকলেও তারা কেউ সাড়া দেননি। এ কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে কাউন্সিলের ডাক দিয়েছেন।’ রওশন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থাকাকালে তেমনভাবে তার খোঁজ নেননি জি এম কাদের। এ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি তিনি। দলের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা তার কাছে গিয়ে বলেছেন, জি এম কাদের তাদের একঘরে করে রেখেছেন। এটিও ভালোভাবে নেননি রওশন।