ডলারের চাপ সামলাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপের প্রভাবে বিদেশ থেকে পণ্য আনার ঋণপত্র বা এলসি খোলার লাগামে টান পড়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির পাশাপাশি কাঁচামাল আসাও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য ইতিবাচক মনে করছেন না ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে কি না—তা জানার অন্যতম সূচক হলো মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানির চিত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৩৯ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন দেশের শিল্পদ্যোক্তারা। এই হার গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ কম।
জানতে চাইলে বাংলাদেশের নিট পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ কারখানা এক্সটেনশনে যাচ্ছেন না। একদিকে যেমন বিশ্ব মন্দার আশঙ্কা, অন্যদিকে দেশে গ্যাস, বিদ্যুতের চরম সংকট। এত সংকটের মধ্যে উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। এজন্য নতুন বিনিয়োগে উদ্যোক্তরা আগ্রহী নয় বলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেছে।
করোনা ভাইরাস মহামারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার পর অর্থনীতি সক্রিয় হতে শুরু করলে সব ধরনের পণ্য আমদানি বাড়তে থাকে। এর মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির হতে থাকে। জ্বালানি তেলসহ সবকিছুর দাম হয় ঊর্ধ্বমুখী। বৈশ্বিক এ প্রভাবের ঢেউ লাগে বাংলাদেশেও। ডলারের চাহিদা ও দর হয়ে পড়ে আকাশচুম্বী। সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে থাকে। আমদানি বাড়ার বিপরীতে আশানুরূপ রপ্তানি ও রেমিটেন্স না আসায় ডলার ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতির সঙ্গে চলতি হিসাবেও ঘাটতি দেখা দেয়। এতে চাপ তৈরি হয় রিজার্ভে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১১৫ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের এলসি খুলেছিলেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ের চেয়ে গত বছরের জুলাই-আগস্টে প্রায় তিন গুণ বেশি মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল।বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ডলারের উচ্চ মূল্য এবং মূল্যস্ফীতির মতো বর্তমানের অস্থিতিশীল পরিবেশে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাবে না বলেই মনে করছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২২ কোটি ১১ লাখ ডলারের এলসি খোলেন শিল্পোদ্যোক্তারা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে তা ১৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। এ হিসাবে, জুলাই মাসের চেয়ে আগস্টে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
আবার টাকার বিপরীতে আমেরিকান মুদ্রা ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেছেন, পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো এখনো ১০৫ টাকার বেশি নিচ্ছে। এতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এত বেশি খরচ করে যন্ত্রপাতি আমদানি করে শিল্প স্থাপন করলে সেই শিল্প লাভজনক হবে কি না—তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। সে কারণেই সবাই মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছেন বলে মনে করছেন তারা।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে।
২০২১-২২ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৬৪৬ কোটি ৩৭ লাখ (৬.৪৬ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন উদ্যোক্তারা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।
গত বছরের আগস্ট থেকে দেশে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। টাকার বিপরীতে ডলারের দর অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাস থেকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। যার সুফল জুন মাস থেকে পড়া শুরু করে। জুলাই-আগস্ট মাসে তা ভালোভাবে দৃশ্যমান হয়েছে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি মানেই নতুন বিনিয়োগ। অর্থনীতির এই অস্থিরতার মধ্যে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। পরিস্থিতি আরো পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি বন্ধ রয়েছে। উচ্চ মূল্য থাকায় আমদানি কমিয়ে দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা আর সরকারও অপ্রয়োজনীয় আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ এনেছে। মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল হলে আগামী বছর ফের আমদানি বাড়তে পারে। এই বছরে খুব একটা পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন না তিনি।