এইতো সেদিনের ঘটনা। ঘটেছে সিরাজগঞ্জের চণ্ডীদাসগাতী গ্রামে। তিরিশ বছর বয়সী আহসানুল্লাহ তার পঁচিশ বছর বয়সী স্ত্রী মর্জিনাকে হত্যা করেছে। কেন হত্যা করেছে তা বলছি। ভোর রাতে আহসানুল্লাহর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙার পর তার হঠাৎ সেক্স করার ইচ্ছে জেগে উঠলো। ঘুম থেকে ডেকে তুললো সে মর্জিনাকে। কী চাই আহসানুল্লাহর? তার এক্ষুণি সেক্স চাই। মর্জিনার ঘুম পুরো হয়নি। সে আরও কিছুক্ষণ ঘুমোতে চাইছে। তখন সে রাজি নয় সেক্সে। কিন্তু আহসানুল্লাহ ছাড়বে কেন? আহসানুল্লাহ তো মর্জিনার স্বামী। স্বামীর আদেশ স্ত্রীকে মাথা নত করে মান্য করতে হয়। ওপরওয়ালাও এমন বিধান দিয়েছেন। অতঃপর আহসানুল্লাহ পুরুষের মতো পুরুষ হয়ে উঠলো। পেশির জোর দেখালো। মর্জিনার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করলো। খবরটি পড়ে চমকে উঠেছিলাম। পরে ভাবলাম, হবে না কেন, তরকারিতে নুন কম দেওয়ার অপরাধে যদি স্ত্রীকে খুন করতে পারে আমাদের পুরুষেরা, তাহলে সেক্স তো নিশ্চয়ই নুনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, খুন না করার কোনও কারণ তো নেই।
তারপরও মন সায় দিচ্ছিল না খবরটিকে নিতান্তই ডালভাত হিসেবে মেনে নিতে। তাই গুগলে খুঁজতে শুরু করেছি আর কোথাও এমন অদ্ভুত ঘটনা কখনও ঘটেছে কি না। আমার তো এবার মাথায় হাত, ঠিক এই ঘটনা অর্থাৎ সেক্সে রাজি না হওয়ার কারণে সঙ্গীকে মেরে ফেলার ঘটনা অহরহ ঘটছে। মূলত স্বামীরাই মেরে ফেলছে স্ত্রীকে। দু’একজন স্ত্রী অবশ্য সেক্সের ব্যাপারে স্বামীর নিস্পৃহ থাকার, এবং জোর জবরদস্তি সেক্স ঘটানোর কোনওটাই মানতে পারেনি বলে ছুরি হাতে নিয়েছে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অধিকাংশ নারী-পুরুষ বিশ্বাস করে, যখন তখন সেক্সের জন্য অগ্রসর হওয়া প্রতিটি স্বামীর অধিকার, এবং প্রতিটি স্ত্রীর কর্তব্য চাহিবামাত্র স্বামীকে নিজের শরীর সমর্পণ করা। এক্ষেত্রে স্ত্রীর ইচ্ছে অনিচ্ছে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং যে নারী স্ত্রী নয়, সে নারীর ইচ্ছে অনিচ্ছের গুরুত্ব কিছুটা হলেও আছে। নারীর ইচ্ছের বাইরে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করার আরেক নাম ধর্ষণ। ইচ্ছেটা স্বতঃস্ফূর্ত কি না-তা দেখাও জরুরি। নারীকে ভয় দেখিয়ে, পিটিয়ে, মাদক খাইয়ে অর্থাৎ ছলে বা বলে বা কৌশলে যৌনসম্পর্কে রাজি করিয়ে যৌনসম্পর্ক করাও কিন্তু আসলে ধর্ষণ করাই।
স্বামিত্বের জোরে স্ত্রীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করাকে অসভ্য দেশে ধর্ষণ না বলা হলেও সভ্য দেশে কিন্তু ধর্ষণ বলা হয়। এবং এই ধর্ষণের দায়ে স্বামীকে জেল খাটতে হয়। অসভ্য দেশগুলো এক সময় ধীরে ধীরে সভ্য হয়ে ওঠে, কিন্তু কিছু অসভ্য দেশ এমনভাবে অজ্ঞতা, অন্ধত্ব, অসমতা, অরাজকতা, অমানবিকতাকে আঁকড়ে ধরে থাকে যে স্বামী নামক পুরুষদের সাত খুন মাফ করে দেয়। এসব অসভ্য দেশে স্বামীকে প্রভু ভাবা হয়, এবং স্ত্রীকে ভাবা হয় দাসি, শুধু দাসি নয়, ক্রীতদাসি, শুধু ক্রীতদাসিও নয়, যৌনদাসি। অফিসিয়ালি ডিক্লেয়ার না করলেও বাংলাদেশের সমাজের অপ্রিয় সত্যটি হলো, স্বামীরা প্রভুর রোল প্লে করে, আর স্ত্রীদের প্লে করতে হয় দাসি কাম ক্রীতদাসি কাম যৌনদাসি বা সেক্স স্লেভের রোল। সে কারণে ম্যারিটাল রেপকে বা স্বামী দ্বারা স্ত্রীর ধর্ষণকে আজও বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণ বলে মানা হয় না। কেনই বা মানা হবে, কোনও কালেই কি পুরুষতন্ত্র যৌনদাসিকে ধর্ষণ করাকে অপরাধ বলে স্বীকার করেছে? আইন যারা তৈরি করে, তারা তো পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাস করা পুরুষই। যৌনদাসির কাজ প্রভু-পুরুষকে যৌনসুখ দেওয়া, যতবার প্রভু-পুরুষ যৌনসুখ চাইবে, ততবারই দেওয়া, সন্ধ্যে-রাত, গভীর রাত, ভোর-রাত, দিন-দুপুর-যে কোনও সময় দেওয়া। যৌনদাসি কোনও অজুহাত দিতে পারবে না যে সে কোনও কাজে ব্যস্ত, বা সে ঘুমোচ্ছে। ধর্মও তো অফ দ্য পুরুষ, বাই দ্য পুরুষ, ফর দ্য পুরুষ। পুরুষের ধর্ম পুরুষের স্বার্থে পুরুষ দ্বারা রচিত। এও তো বলে, ‘স্বামীরা সহবাসের জন্য ডাকলে স্ত্রীরা যেখানেই থাকুক, এক পর্বত থেকে আরেক পর্বতে হলেও তাদের ছুটে আসতে হবে, তা না হলে ফেরেশতারা স্ত্রীদের সারারাত অভিশাপ দেবে।’ প্রভু-পুরুষকে চাহিবামাত্র যৌনসুখ দিতে স্ত্রীদের বাধিত থাকতে হবে। যৌনদাসির কোনও সুখ হলো কি না, সেটি কিন্তু কেউ দেখে না। যৌনদাসি সঠিকভাবে তার কর্তব্যটি বা দায়িত্বটি সম্পন্ন না করলে প্রভু-পুরুষ তার ওপর রুষ্ট হবে, এটিকে স্বাভাবিক বলেই লোকে ভাবে। রুষ্ট হতে হতে যৌনদাসিকে যদি হত্যাও করে, তাতেও লোকে অবাক হয় না, ভেবে নেয় দোষ নিশ্চয়ই যৌনদাসিরই ছিল। বাংলাদেশের এই ঘটনার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে বলে আমার মনে হয়। লোকে খুনি স্বামীকে নয়, দোষ দিচ্ছে স্ত্রীর রোল প্লে করা যৌনদাসিটিকেই। তোর এত স্পর্ধা কী করে হয় স্বামীর সহবাসের বা ধর্ষণ করার ইচ্ছেকে মূল্য না দেওয়ার!
পুরুষতন্ত্রের খুব বেশি বিবর্তন হয় না। এটি সাধারণত এক জায়গায় স্থির থাকে। সে কারণেই দেখি সপ্তম শতাব্দীতে পুরুষতন্ত্রের চেহারা যেমন ছিল, একবিংশ শতাব্দীতে পুরুষতন্ত্র একই রকম চেহারা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এটি বিরতিহীন অপরাধ করছে, সুযোগ পেলেই ভায়োলেন্স করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, মানুষের ঘাড় মটকে খাচ্ছে। তারপরও এটির বিরুদ্ধে সরব হতে বেশি কাউকে দেখি না।
পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী পুরুষেরা বার বার প্রমাণ করছে তারা বিকট এক পুরুষাঙ্গ ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের মস্তিষ্ক অকেজো, তাদের মন বিকল। পুরুষাঙ্গই তাদের সর্বাঙ্গ হয়ে উঠেছে, তাদের মন এবং মস্তিষ্ক হয়ে উঠেছে। পুরুষাঙ্গই তাদের পথ দেখায়, পুরুষাঙ্গই তাবৎ নারীকুলকে যোনী বলে ভাবতে শেখায়। পুরুষাঙ্গই ধর্ষণে ইন্ধন জোগায়, ধর্ষণে কেউ রাজি না হলে তাকে অনায়াসে খুন করে। পুরুষতন্ত্র সেই আদিকাল থেকে পুজো করছে পুরুষাঙ্গের, আজও করছে। পুরুষাঙ্গসহ জন্ম নিলে মহামানবের মতো জীবন উপভোগ করা যায়, বিশেষ করে যারা পুরুষাঙ্গসহ জন্ম নেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছে তাই করা যায়। তাদের বিরুদ্ধে ঘটানো কোনও অপরাধই তখন আর অপরাধ নয়।
এই অবস্থার পরিবর্তন কি সম্ভব নয়? মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্য দেওয়ার সংস্কৃতি কি কোনও দিনই পুরুষতন্ত্র অধ্যুষিত অঞ্চলে পায়ের ধুলো দেবে না? যদি এমনই হয়, তবে হতাশা ছাড়া কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না। তাবৎ উন্নয়নও হতাশার বন্যায় ভেসে যাবে। কিন্তু এমনও তো পুরুষ আছেন, পুরুষাঙ্গ যাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে না, বোধ বুদ্ধি বিবেক যাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে! তাঁরা কোন গোপন গুহায় বাস করেন, আমার জানা নেই। তাঁরা তো গুহা থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষাঙ্গ এবং পেশিসর্বস্ব বীরপুঙ্গবদের মস্তিষ্কে বুদ্ধি বিবেক কিছু ঢোকাতে পারেন। তাদের কিছুটা সভ্য হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। জানি তাঁরা বলবেন, পরামর্শে কাজ হবে না। তবে কি ধরে ধরে জেলে ভরে রাখলেই কাজ হয়? কাজ কি হয়েছে কখনও? তাছাড়া ক’জনকে জেলে ভরবেন? ঠক বাছতে যে গাঁ উজাড় হবে!
নারীবিদ্বেষ না থাকলে পুরুষতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকে না। নারীবিদ্বেষ থেকে জন্ম হয় পুরুষতন্ত্রের, আবার পুরুষতন্ত্র থেকে জন্ম হয় নারীবিদ্বেষের। এরা ক্রমাগত একে অপরকে জন্ম দিচ্ছে, এরা একে অপরের ভীষণভাবে পরিপূরক।
গার্হস্থ্য হিংসে বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার মূলত মেয়েরা। একে ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ না বলে বরং ‘ভায়োলেন্স এগেইন্সট উইমেন’ বা ‘নারী-নির্যাতন’ বলা উচিত। মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু তার আপনজনেরা। তারাই মেয়েদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। প্রতিদিন মেয়েরা স্বামী বা প্রেমিকের অত্যাচারে আত্মহত্যা করছে, অথবা স্বামী বা প্রেমিক দ্বারা খুন হচ্ছে। প্রতিদিন মেয়েরা, শিশু থেকে বৃদ্ধা অবধি ধর্ষণের এমনকী গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। প্রতিদিন মেয়েরা পুরুষের বর্বরতা, বৈষম্য, শিশু পাচার, যৌন হেনস্থা, গার্হস্থ্য হিংসে- ইত্যাদি হাজারো সমস্যায় ভুগছে। এসবই পুরুষতন্ত্রের উপহার।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আগাগোড়া একটি অসুস্থ সমাজ এই সমাজকে সুস্থ করতে চাইলে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দিতেই হবে, নারীকে শৃঙ্খলমুক্ত করতেই হবে, নারীর শিক্ষা-স্বনির্ভরতার ব্যবস্থা করতেই হবে, নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে দেখার মানসিকতা বদলাতেই হবে।
পুরুষতন্ত্রকে বিদেয় না করলে নারীর মুক্তি অসম্ভব। অনেক পুরুষই, এমনকী ভালো পুরুষও পুরুষতন্ত্রকে বিদেয় করতে ভয় পায়। তারা মনে করে, পুরুষতন্ত্র বিদেয় হলে নারীতন্ত্র আসবে। তারা জানে না পুরুষতন্ত্রের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা যারা লড়াই করছি, তারা নারীতন্ত্র আনার জন্য লড়াই করছি না। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা আসলে সমানাধিকারের লড়াই, মানবতা আর মানবতন্ত্রের লড়াই।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা