আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৭) এসব বিষয় নিয়ে জোরালো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আমাদের জন্য উচিত হবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আলোচ্য ইস্যুগুলোকে পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিবেচনা করা।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে স্বীকৃত। এই দেশের অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান, প্লাবনভূমির আধিপত্য এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিম্ন উচ্চতা, উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব, দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং এর উপকারিতাসমূহের ওপর একচ্ছত্র নির্ভরতার কারণেই এমনটা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইতিমধ্যে কয়েক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দেশের উন্নয়ন ধারা ব্যাহত হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের অভিযোজন (অ্যাডাপ্টেশন) ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। বৃষ্টিপাতের ধরন ও তাপমাত্রার ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রভাবে হিমালয়ের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে এবং কৃষকদের এই ক্ষতি মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য এখন গোষ্ঠীভিত্তিক অভিযোজন-এর (কমিউনিটি বেইজড অ্যাডাপ্টেশন-সিবিএ) চিন্তা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের বেশির ভাগ লোক কোনো না কোনোভাবে কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশের কৃষি খাতে বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের উপকূল ও চরাঞ্চলগুলোতে মানুষ কৃষিকাজ ও মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। এসব অঞ্চলের মানুষের কৃষিকাজ পানির ওপর নির্ভরশীল। বছরের বৃহত্ একটা সময় চরের নিম্নভূমি পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া চরের মাটিও অন্যান্য মাটির চেয়ে ভিন্ন। চরের কৃষি ব্যবস্থাপনা গতানুগতিক। পাশাপাশি চরাঞ্চলে কৃষির আধুনিক সুযোগগুলোর অপ্রতুলতাও রয়েছে। অধিকন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে চরগুলোতে বর্ষা মৌসুমে বন্যা, নদীভাঙন, বজ পাত, ঘূর্ণিঝড়, শুকনো মৌসুমে খরা, আর্দ্রতার অভাব ইত্যাদি সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করছে। অন্যদিকে উপকূল অঞ্চলে লবণাক্ত পানির প্রভাব দিনদিন বেড়েই চলছে। ফলে কৃষিজমির কার্যকারিতা হারাচ্ছে এবং সুপেয় পনির সংকট বাড়ছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূল অঞ্চলের প্রধান সুপেয় পানির উত্স পুকুরগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাব অব্যাহত থাকলে চরাঞ্চল ও উপকূল অঞ্চলে দিন দিন মানবিক, অর্থনৈতিক ও জীববৈচিত্র্যসহ সামাগ্রিক সংকট বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষের জীবন ও জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এই ক্ষতি এড়াতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গোষ্ঠভিত্তিক অভিযোজন (সিবিএ) কার্যক্রম বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।
আশার দিক হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু সহনশীল বাংলাদেশ গড়তে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান-ন্যাপ) চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়াধীন। জলবায়ু পরিবর্তনের ‘ফ্রন্টলাইনার’দের পর্যাপ্ত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম দিয়ে সার্বিক বিষয়ে প্রস্তুত করা সময়ের দাবি, যাতে তারা প্রয়োজনে তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট এবং ফলাফল খুবই অনিশ্চিত ও আকস্মিক। ফলে এর ঝুঁকি ও ক্ষতি পরিমাপ করা খুব একটা সহজ হয় না। তাই এসব অঞ্চলের অধিবাসীদের স্থানীয় জ্ঞানকে আমলে নিয়ে তার সঙ্গে নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তিসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্থানীয় অধিবাসীরা যুগের পর যুগ এসব অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। তাদের নিজস্ব কিছু সহজাত জ্ঞান রয়েছে যেগুলো ব্যবহার করে তারা দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে। স্থানীয় তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে তাদের সহজাত শস্য চক্র, ঝুঁকি চক্র এবং জীবনযাত্রার চক্রকে বিবেচনায় নিয়ে আধুনিক জ্ঞানকে সমন্বয় করে স্থানীয় অভিযোজন মডেল প্রস্তুত করতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভালো ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। স্থানীয় বৈচিত্র্যগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সিডর বা মহসেনে স্থানীয় গাছগুলো ক্ষতি হ্রাসের ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে। তাই স্থানীয় বৈচিত্র্যগুলোকে পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-উক্রেন যুদ্ধ আমাদের আরো একবার শিখিয়ে গেছে যে, আমাদের প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের (ন্যাচার বেইজড সল্যুশন) কথা ভাবতে হবে।
এছাড়া স্থানীয় প্রাকৃতিক ভূচিত্রকে (লোকাল ল্যান্ডস্কেপ) আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। নদী-নালা, খাল-বিল, বনজঙ্গলসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক অবকাঠামোর আকৃতি-প্রকৃতি কেমন ছিল এবং এগুলো কীভাবে পরিবর্তন হয়েছে—তা বোঝা দরকার। আমরা যদি স্থানীয় ভূচিত্রকে পুনরুদ্ধার বা সংরক্ষণ করতে পারি, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করার পথ আরো সুগম হবে। তবে এজন্য সেই স্থানীয় অধিবাসীদের সহজাত জ্ঞানকেই কাজে লাগাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে স্থানীয় ভূচিত্রের কেমন পরিবর্তন হয়েছে, তা ভূচিত্রের আদিপ্রকৃতি দেখে যথাসম্ভব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা এবং কর্মকৌশল ঠিক করা প্রয়োজন। স্থানীয় সম্পদসমূহকে একটি তালিকায় নিয়ে আসা দরকার। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা আছে যেগুলো স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এসব স্থানীয় সম্পদসমূহকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে স্থানীয়দের সহজাত জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব হবে। সারা বিশ্বে এখন আগাম কার্যক্রম (এন্টিসিপেটরি অ্যাকশন) গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ আগাম কার্যক্রম জলবায়ুজনিত ক্ষয়ক্ষতিকে হ্রাস করতে সাহায্য করে। এজন্য প্রয়োজন স্থানীয়ভিত্তিক (লোকাল বেইজড) কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন। সেটির আলোকে সম্পদ ও সুযোগসমূহকে প্রস্তুত রাখা জরুরি। এগুলো করতে পারলে বৈশ্বিক নিঃসারণ নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত সমন্বিত অভিযোজন প্রচেষ্টার মাধ্যমে চলমান ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নাহলে নিঃসারণ সংক্রান্ত বৈশ্বিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে থাকতে গেলে আমাদের চলমান ক্ষতি আরো বাড়তে থাকবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় সরকারের অধিকতর সুযোগ ও সম্পদসহ উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার বিষয়ক কর্মসূচিসমূহ জলবায়ু প্রেক্ষাপটে ঢেলে সাজাতে হবে।
স্থানীয় উদ্যোগে অভিন্নতা ও অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য একটা নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত হবে। এজন্য স্থানীয় নেতৃত্বে অভিযোজন শীর্ষক যে আটটি নীতিমালাকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো সবার জন্য অভিন্ন নীতিমালা হতে পারে। আমাদের উচিত হবে সেগুলো অনুসরণ করা। তাহলে স্থানীয়ভিত্তিক অভিযোজন প্রক্রিয়াটি পরিচালনার জন্য বৈশ্বিকভাবে সবার জন্য একটি গতিবেগ তৈরি হবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সিবিএ-১৬ সম্মেলনে এসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশে উপরিউক্ত বিষয়গুলোকে আরো শক্তিশালী করার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। তাহলে আমরা আগামী দিনের জন্য পাথেয় খুঁজে বের করতে পারব। এসব উদ্যোগ আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে শুরু করতে পারি। সেজন্য আমাদের বৈশ্বিক সিদ্ধান্তের জন্য বসে থাকতে হবে না। আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৭) এসব বিষয় নিয়ে জোরালো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আমাদের জন্য উচিত হবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আলোচ্য ইস্যুগুলোকে পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিবেচনা করা। আমাদের দূরদর্শী চিন্তা, কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা এবং তদানুযায়ী কার্যক্রম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে অনেকাংশে সুফল পাওয়া সম্ভব।
লেখক: উন্নয়ন ও জলবায়ু বিষয়ক কলামিস্ট এবং হেড অব ক্লাইমেট অ্যাকশন, ফ্রেন্ডশিপ