আজ আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। গ্রামীণ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ নানা ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে বিশ্বজুড়ে। গ্রামীণ নারীর বহুমাত্রিক ভূমিকা ও অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়ার জন্য আন্দোলন চলছে যুগ যুগ ধরে। তবে এর মাঝে একটু একটু করে উন্নতি করছেন অনেকেই। সমাজের অগ্রগতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান অনস্বীকার্য।
এখনো ঘরে বাইরে নানা বৈষম্যের শিকার গ্রামীণ নারীরা। দেশে নারী দিবস শত বছর পার করলেও এখনো শ্রমের স্বীকৃতি মেলেনি গ্রামীণ নারীদের। সংসারে তো বটেই, বাইরে পরিশ্রম করে নারী বলেই তাকে হতে হচ্ছে অবমূল্যায়িত। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি বঞ্চিত নারী কৃষি-শ্রমিকরা। নারী নির্যাতনের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। সমাজ-সংসার-কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায়ই নারীকে কোন না কোনো ভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী; আর তার শতকরা ৮৬ ভাগের বাস গ্রামে। গবেষণায় দেখা যায়, গ্রামীণ নারীরা দিনের মোট সময়ের শতকরা ৫৩ ভাগ ব্যয় করে কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্প ক্ষেত্রে। যেখানে পুরুষরা ব্যয় করে শতকরা ৪৭ ভাগ সময়। তারা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা সব কাজে আজ অবদান রেখে চলছে। তারপরও তাদের সমাজে পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে। দেশে প্রায় দুই কোটি কর্মজীবী নারীর মাঝে দেড় কোটিই গ্রামীণ নারী। নারীরা সাধারণত সবসময় পরিবারের আয়ের দিকে ঝুঁকে থাকে। তারা সংসারমুখী হয়ে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িত হয়। কুটিরশিল্প, ছোটখাটো ব্যবসা বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত হওয়া আগের তুলনায় কিছুটা কমে এলেও কৃষিখাতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো তুলনামূলক বেশি। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল উত্পাদন, শস্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে রয়েছে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। বাংলাদেশ যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, এতে আমাদের গ্রামীণ নারীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু কৃষক হিসেবে না পরিবার থেকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, না সরকারিভাবে স্বীকৃতি মিলছে। কৃষি থেকে আসা আয়েও নারীদের ভাগ শূন্য। তাছাড়া ভূমিতে নেই সমঅধিকার, নেই কৃষিঋণে। দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা গৃহস্থালি কাজ হোক বা কৃষি-পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করে নারীদের এসব কাজ করতে হচ্ছে অবৈতনিক। অথচ এসব কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত প্রতিষ্ঠার সুযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য ও নির্যাতনের হার কমে আসবে।
নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। নারীদের আজও সমাজে অবহেলার চোখে দেখা হচ্ছে। বাল্য বিয়ে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়া, পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা তো আছেই। তাদের উন্নতির কোনো চিন্তা না করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা হয়। এখনো শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন অকালে প্রাণ কেড়ে নেয় গৃহবধূর।
আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তেমন পার্থক্য না থাকলেও উচ্চশিক্ষার বেলায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে বেশ; যার কারণ বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, অভিভাবকের সদিচ্ছার অভাব এবং নিরাপত্তাহীনতা। এ লক্ষ্যে তাদের যে বিশেষ সুবিধাগুলো দরকার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিক্ষার সমান সুযোগ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর রয়েছে শক্তিশালী ভূমিকা। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন নারীর অনেকেই কর্মপরিবেশ আর সংস্থানের সুযোগ না থাকায় তাদের ভূমিকা মেলে ধরতে পারছে না। ফলে দেশও হারাচ্ছে উন্নয়নের অংশীজন। বাংলাদেশের নারীরা সমাজের সর্বস্তরে বৈষম্যের শিকার।
কয়েক দশক ধরে নারীকে মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু নানা কারণে নারীর উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছেনি। তবে বিভিন্ন আইন ও সচেতনতামূলক কর্মসূচির ফলে গ্রামীণ নারীদের বৈষম্যের হারও দিন দিন কমে আসছে।
খুলনা