সারা বিশ্বেই এখন অস্থিরতা। ক্রমেই বাড়ছে। আগামী ছয় মাসে সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে বলে ব্রিটেনভিত্তিক ইন্টেলিজেন্স ফার্ম জানিয়েছে। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি দেশের নাগরিকরা এখন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলে সম্প্রতি খাদ্য ঘাটতির জন্য বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা এবং যুদ্ধ বিগ্রহকে দায়ী করে বলেছেন, পৃথিবীর ৪৫টি দেশের দরজায় এখন দুর্ভিক্ষ কড়া নাড়ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পৃথিবীতে যত মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছে তার মধ্যে ৬০ শতাংশ বসবাস করে যুদ্ধ-বিগ্রহকবলিত এলাকায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, খাদ্য এবং সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮টি দেশকে অতিরিক্ত ৯০০ কোটি ডলার খরচ করতে হবে।
বিশ্বের মূল সংকট এখন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। এতে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি বেড়েছে। তেলের উত্পাদন ও মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে উষ্ণ সম্পর্কের মধ্যে থাকা যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের সম্পর্কও শীতল হতে শুরু করেছে। চীন-তাইওয়ান উত্তেজনাও নাড়া দিচ্ছে বিশ্বকে। এরই মধ্যে হিজাব পরাকে ঘিরে চলা আন্দোলনে ইরানে আরব বসন্তের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কৃত্রিম এসব সংকটের মধ্যে বিশ্বকে বিপদে ফেলতে প্রাকৃতিক দুর্যোগও থেমে নেই। ঘূর্ণিঝড়, খরা ও বন্যার কারণে ফসলহানির শঙ্কাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
অস্থিরতার মধ্যে ১০১ দেশ
চলতি বছরের বৈশ্বিক শান্তি সূচকেই জানানো হয়েছিল, সারা বিশ্বে শান্তি ০ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। সংখ্যায় সূচক কম মনে হলেও এ ধারা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে গত জুনে আশঙ্কা করা হয়েছিল। ব্রিটেনভিত্তিক রিস্ক কনসাল্টিং অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ফার্ম ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফট ১৯৮টি দেশের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। এর মধ্যে ১০১টি দেশেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। ইন্টেলিজেন্স ফার্মটির সমীক্ষা বলছে, মাত্র ৪২টি দেশে অস্থিরতা কমার তথ্য পাওয়া গেছে। ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফট জানিয়েছে, পেরু, কেনিয়া, ইকুয়েডর এবং ইরানে দ্রব্যমূল্যের অতিরিক্ত দাম ঘিরে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক অস্থিরতাকে ঘিরে সবচেয়ে বড় অস্থিতিশীল অবস্থায় ছিল শ্রীলঙ্কা। দেশটির প্রেসিডেন্টকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়, যদিও পরে ফিরে আসেন। মধ্যম আয়ের দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি নাগরিক আন্দোলনের মুখে পড়েছে। তবে এ বছর উন্নত দেশগুলোও মুদ্রাস্ফীতি অর্থাত্ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে বাদ যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উন্নত দেশগুলোও এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। ইউরোপের সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভেনিয়ায় অর্থনীতির পতন হয়েছে।
গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতে জার্মানিতে ব্যাপক লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। শীতকালে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছে দেশটি। কারণ দেশটির জ্বালানির অধিকাংশ চাহিদা মিটিয়ে থাকে রাশিয়া। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতা করায় দেশটিতে জ্বালানিসংকট বৃদ্ধির চেষ্টা করছে মস্কো। নেদারল্যান্ডসের ১৫ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। কিন্তু আমদানিতে সংকট দেখা দিয়েছে। আবার দেশটিতে সম্প্রতি এক ভূমিকম্পে ২৬ হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়, পাকিস্তানে প্রবল বন্যা, জাপানে চলতি বছরের ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট ভূমিধস, ব্রিটেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে প্রবল খরায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আগে এসব দেশে খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকলেও এবার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের খাবার প্রাপ্যতার হার কমেছে ব্যাপকহারে। ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফট জানিয়েছে, খাদ্য ও জ্বালানিসংকটের জেরে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি আগামী বছর পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলতে পারে। ইন্টেলিজেন্স ফার্মটি বলছে, খাদ্য এবং জ্বালানিসংকট দেশে দেশে বেসামরিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারে। খাদ্যসংকটের জন্য বড় একটা কারণ হিসেবে খরাও ভূমিকা রাখতে পারে বলে সতর্ক করেছে ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফট।
ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন চালানোর পর জ্বালানি ও খাদ্যসংকট বেড়েছে। কারণ ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে কৃষি পণ্যের একটা বড় অংশ বিশ্ব জুড়ে আমদানি হয়। এরই মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ এবং ন্যাটো মহাসচিব, এমনকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও পুতিনের পরমাণু হুমকিকে অবহেলা করছেন না। যদিও পশ্চিমা বিশ্ব কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করলে রাশিয়াকে নজিরবিহীন পরিণতি ভোগ করতে হবে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞায় বিপদে পড়েছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। তবে এবার উন্নত বিশ্বের নাগরিকরাও যুদ্ধের ফল ভোগ করছেন। এদিকে উত্তর কোরিয়ার বারবার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। শুক্রবারও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান পালটা ক্ষেপণাস্ত্র ও সামরিক মহড়া চালাচ্ছে। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন আতঙ্ক।
যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্কে নতুন মোড়
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যাকাণ্ডের জেরে সৌদি আরবের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। খাশোগিকে হত্যার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টে মূলত সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দায়ী করা হয়। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী আবার বাড়ে। সমালোচনা হলেও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। কিন্তু চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করে নভেম্বর থেকে তেল উত্পাদন কমানোর ঘোষণা দেয় ওপেক প্লাস যার নেতৃত্বে আছে সৌদি আরব এবং রাশিয়া। এমনকি ইউরোপের বাজারে তেলের দাম কমিয়ে সৌদি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়িয়ে দেয়। তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি নভেম্বরে মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটরা। এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন সৌদি আরবের ওপর ক্ষেপেছে। দেশটির সঙ্গে মার্কিন সহযোগিতার সম্পর্ক ছিন্ন করতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর চাপ বাড়ছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করাটা জরুরি হয়ে পড়ছে। এমনকি সিনিয়র ডেমোক্র্যাটরা সৌদি থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানিয়েছেন।
চীন-তাইওয়ান সংকট ও ইরানে আন্দোলন
তাইওয়ানে চলতি বছর মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির আকস্মিক সফরকে কেন্দ্র করে তাইওয়ান উত্তেজনা বাড়ে। চীন তাইওয়ানের চারপাশে ব্যাপক সামরিক মহড়া চালায়। তাইওয়ান দখল করারও হুমকি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো তাইওয়ানের পাশে দাঁড়ায়। তাইওয়ানে চীন হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র রক্ষা করবে বলেও প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাইওয়ান এখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে শুরু করেছে। রাশিয়া চীনের পাশে দাঁড়িয়েছে। চীনে শি জিনপিং তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তাইওয়ানে হামলা চালাতে পারেন বলেও আশঙ্কা করছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট। কারণ শি জিনপিং ২০৪৯ সালের মধ্যে তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করার অঙ্গীকার করেছেন। ফলে এই সংকট দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বকে ভোগাবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এদিকে ইরানে পোশাকের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে ২০১১ সালের মতো আরব বসন্তের আশঙ্কা করছেন অনেকে। বিক্ষোভকারীদের দমনে তাজা গুলি ব্যবহার করছে সরকার।
দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা
বিশ্ব জুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যখন দিশাহারা তখন আরো খারাপ খবরের আভাস মিলছে। ২০২৩ সালে সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কায় এখনই নানা ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে বলেছে যে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এফএও এবং ডব্লিউএফপির যৌথ রিপোর্টে বলা হয়েছে, আফ্রিকার ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া এবং সাউথ সুদানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রবল। ইয়েমেন এবং আফগানিস্তানেরও একই দশা। এশিয়া ও আফ্রিকার আরো কিছু দেশেও তীব্র খাদ্য ঘাটতি হতে পারে বলেও রিপোর্টে উঠে এসেছে।
খাদ্যসংকটের জন্য কয়েকটি কারণের মধ্যে প্রধান হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তাদের রিপোর্টে বলেছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সারের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আফ্রিকা মহাদেশে খাদ্য উত্পাদন ২০ শতাংশ কমে যাবে। চলতি বছরের জুনে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেন, ২০২২ সালে কয়েকটি দুর্ভিক্ষ ঘোষণার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং ২০২৩ সালে সেটি আরো খারাপ হতে পারে।
দ্বিতীয় কারণ, জলবায়ুজনিত। পৃথিবীর অনেক দেশ হয়তো বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, নয়তো খরায় ভুগছে। তৃতীয়ত, করোনা মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সেটি এখনো কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। চতুর্থত, জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় এখন তাদের পরিচালনা ব্যয় যতটা বেড়েছে সেটি দিয়ে তারা প্রতি মাসে ৪০ লাখ মানুষকে খাওয়াতে পারত।
খাদ্য উত্পাদন কমে যাওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ কৃষি উত্পাদনের জন্য সার ও ডিজেলের মতো উপকরণের দাম বৃদ্ধি। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হুসেইন ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাকে বলেন, এখন সারের দাম বেশি এবং অনেকে কিনতে পারছেন না। এ বিষয়ে নজর দেওয়া না হলে আগামী বছর সার পাওয়াই যাবে না। কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য বিশ্ববাজারে রপ্তানির জন্য গত জুলাইয়ে জাতিসংঘ এবং তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া অভিযোগ করছে, তারা তাদের শস্য এবং সার বিশ্ববাজারে রপ্তানি করতে পারছে না। এটা অব্যাহত থাকলে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া।