মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে শান্তি আলোচনা বা সমঝোতার সবরকম উদ্যোগই ব্যর্থ হয়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা ক্ষমতা দখল করে। ব্যাপক আন্দোলন ও প্রতিরোধের পরও তারা নিজেদের অবস্থান থেকে একচুলও নড়েনি। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো কাজ অবলীলায় করে গেছে। প্রতিবাদকারীদের ওপর দমনাভিযান কমেনি। এখনো পর্যন্ত সুর নরম করার কোনো লক্ষণ দেখায়নি জান্তা।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব অনুরোধ উপেক্ষা করে মিয়ানমারের জান্তা সম্প্রতি চারজন গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। তারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কোনো রকম পাত্তাই দিচ্ছে না তারা। জান্তা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অটল আছে। বৈশ্বিক সম্প্রদায়েরও সম্ভবত এটা উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে তাদের অনুরোধে কান দিতে প্রস্তুত নয় মিয়ানমারের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। দেশটিতে বেসামরিক শাসন ফিরিয়ে আনার আশা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ছাড়া চাপ প্রয়োগ করার কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। বৈশ্বিক আবেদনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই চলেছে সামরিক শাসক গোষ্ঠী। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন তাদের সামনে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে যাচ্ছে। বৈশ্বিক শক্তিগুলোর উচিত বিষয়টি আমলে নিয়ে নতুনভাবে কর্মপন্থা ঠিক করা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ এ পর্যন্ত ১০০-এর ওপর বিবৃতি জান্তার কাছে পাঠিয়েছে। সব বিবৃতির মূলকথা মোটামুটি একই রকম; সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের নিন্দা ও দ্রুত বেসামরিক শাসন ফিরিয়ে আনার আহ্বান। কিন্তু জান্তা এসব আহবানে সাড়া দিতে মোটেই গরজ অনুভব করছে না।
জাতিসংঘের ও পশ্চিমা দেশগুলোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রায়ই মিয়নমারের সামরিক অভ্যুত্থান ও সেনা শাসনের নিন্দা করে বিবৃতি দিয়ে থাকেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, জাতিসংঘের মহাসচিব অন্তেনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘আধুনিক বিশ্বে সামরিক অভ্যুত্থানের কোনো স্থান নেই।’ যুক্তরাষ্ট্র ও আসিয়ান নিয়মিত সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার আহবান জানিয়ে এসেছে। মিয়ানমারের অনেক সেনা সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছেন। পশ্চিমা হুঁশিয়ারিকে জান্তা এক রকম বাগাড়ম্বর হিসাবেই নিচ্ছে। সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ সোয়ে উইন এমন কথাও বলেছেন বলে শোনা গেছে যে, ‘অল্প মিত্র নিয়ে কীভাবে চলতে হয় সেটা আমরা শিখে গেছি।’ মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের অন্যতম চীন। যদিও জান্তাকে সমর্থনের জন্য বেইজিং ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। তা সত্ত্বেও চীন সীমিত পরিসরে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।’
অন্যদিকে জান্তার সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করছে কিছু দেশ। বিশেষ করে আসিয়ান পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। উদ্দেশ্য অভ্যুত্থান পরবর্তী মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের একটি ক্ষেত্র তৈরি করা। আসিয়ান আশা করছে জান্তা ক্রমাম্বয়ে নমনীয় হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় না হোক প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে স্বাভাবিক করবে। আসিয়ানের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাম্বোডিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রাক সখোন সম্প্রতি নিরাপত্তা পরিষদের এক সভায় বলেছেন, ‘মিয়ানমারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা আসিয়ান এখনো সব আশা হারিয়ে ফেলেনি। মিয়ানমারের বিরোধী নেত্রী অং সান সুচিসহ গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের বহু নেতাকর্মীকে কারা অন্তরীণ করার পরও তিনি আশা ছাড়তে রাজি নন। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এ ব্যাপারে আসিয়ানের কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নেই।
মিয়ানমারে দশকের পর দশক সামরিক শাসন চললেও ২০১১ সালের পর সেখানে গণতন্ত্রের বাতাস বইতে শুরু করেছিল। যদিও সেটি খুবই সীমিত পরিসরের গণতন্ত্র। তবে তারপরও জনগণের নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের ভূমিকা রাখার একটি সুযোগ এসেছিল। আন্তুর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে জান্তাকে বিচারের মুখোমুখি করা। সে রকম কোনো তৎপরতাও দেখা যায়নি। সেটি করা হলে জান্তার পুনরায় ক্ষমতা দখল এত সহজ হতো না। মিয়ানমারে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্কট মার্সিয়েল গত বছর লিখেছিলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ২০১৬ সালের শুরুর দিকে আমি জেনারেল মিন অং লিয়াংসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছিলাম। বৈঠকগুলোতে আমি এটি স্পষ্ট জানিয়েছিলাম গণতন্ত্রের জন্য আরও সংস্কারমূলক পদক্ষেপ এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করলেই কেবল মার্কিন সেনাবাহিনী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে।