সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ছানোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তির দুধ দিয়ে গোসলের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ওয়ার্ড যুবলীগের সম্মেলনে সভাপতির পদ না পেয়ে তিনি জনসমক্ষে দুধ দিয়ে গোসল করে আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনের রাজনীতি থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেন (যদিও পরে এক ভিডিও বার্তায় স্থানীয় নেতাসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে এজন্য তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন)!
এর আগে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় উপজেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মো. আরমিন নামের ছাত্রলীগের এক নেতা। দুধ দিয়ে গোসলের সেই ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল।
‘কলঙ্কমুক্ত’ হতে দুধ দিয়ে গোসল করার এমন সংবাদ প্রায়ই শোনা যায়। দুধ দিয়ে গোসলের মাধ্যমে ‘কলঙ্কমুক্ত’ বা ‘পবিত্র’ হওয়ার এই ধারণা প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যমান। যদিও দুধ গোসলের জন্য নয়। তবু এমনটি ঘটে থাকে। সাধারণত কোনো খুশি বা অর্জনের মুহূর্তেই কিছু মানুষকে দুধ দিয়ে গোসল করতে দেখা যায়। নির্বাচনে জয়লাভ করে বা নতুন বিয়ে করে দুধ দিয়ে গোসল দেশের গ্রামাঞ্চলে একটি পুরোনো প্রথা। এখন যোগ হয়েছে ‘কলঙ্কমুক্ত’ হওয়ার বাসনা। যদিও এটি একটি উদ্ভট, অপ্রয়োজনীয় কুসংস্কার।
কলঙ্কমুক্ত হওয়া বা পবিত্রতা অর্জনে দুধের প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা, কোনোটিই নেই। নিজের পয়সায় কেনা দুধের মতো পবিত্র জিনিস দিয়ে গোসল করব, এতে দোষ কী—এ জাতীয় ধারণাও ঠিক নয়। কারণ দুধ পবিত্র হলেও এর ব্যবহার সঠিক স্থানে হতে হবে। দুধ দিয়ে গোসল করা মানে অর্থ ও খাদ্যের অপচয়।
দুধ আমাদের দেশে একটি সেরা খাদ্য। দুধ-ভাত একসময় ভালো খাদ্যের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতো। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে বর্ণিত ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ এখনো যেন সব মা-বাবার প্রার্থনা।
আসলে পৃথিবীর সব খাদ্যের সেরা খাদ্য দুধ। সর্বোচ্চ পুষ্টিমানের জন্যই দুধের শ্রেষ্ঠত্ব। দুধের অপরিহার্য উপাদান ল্যাকটোজ, যা দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে সহায়ক। মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার মূল-উপাদান দুধ। বাংলাদেশের জনগণের একটি বৃহত্ অংশ তরল দুধপান থেকে বঞ্চিত। দুধকে আমরা বিলাসী খাদ্যের তালিকায় বন্দি রেখেছি। গরুর দুধে আছে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ; যেমন :ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম। গরুর দুধের কম্পোজিশনে পানি ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ল্যাকটোজ ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ফ্যাট ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রোটিন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। গরুর দুধ সব পুষ্টির আধার ও শক্তির উত্স।
দুধ শরীরকে ভালো ও সুস্থ রাখার পাশাপাশি, শরীরে শক্তি জোগায় এবং ক্লান্তি দূর করে। মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। দাঁত ও হাড় মজবুত রাখে। মাংসপেশি গঠনে ভূমিকা রাখে। চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, কম চর্বিযুক্ত দুধ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। পাকস্থলী পরিষ্কার রাখে এবং হজমশক্তি বাড়ায়। এ ছাড়া রোগপ্রতিরোধ-ক্ষমতা বাড়ায়।
দুধ অনন্যশক্তি ও অসাধারণ পুষ্টির আধার। পুষ্টিবিদরা সব সময় দুধকে মূল-খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, পরিপূরক খাদ্য হিসেবে নয়। নিয়মিত দুধ খেলে বার্ধক্যকে তারুণ্যে পরিণত করা যায়। দুধেই জীবনরক্ষা, স্বাস্থ্যরক্ষা ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব। দুধের অভাবেই জরাগ্রস্ততা, ব্যাধিগ্রস্ততা আসে।
যদিও আমাদের কাছে গরুর দুধ এখন বাঘের দুধে পরিণত হয়েছে। টাকাওয়ালারাই কেবল দুধ খেতে পারে। ভাত জোটে না, দুধ রোজ, দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পোষা, যে গাই দুধ দেয় এর লাথিও মধুর, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো—আমাদের দেশে দুধ নিয়ে এমন অনেক বাক্য প্রচলিত আছে। সুসময়ের বন্ধুকে ‘দুধের মাছি’ দিয়ে প্রতীকী অর্থে প্রকাশ করা হয়। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে এমন দুধের মাছির আনাগোনা বেশি লক্ষ করা যায়।
যাহোক, বর্তমানে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খাঁটি দুধ পাওয়া। অন্য সবকিছুর মতো দুধেও এখন ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। আগে দুধে শুধু পানি মেশানো হতো। এখন নানা ধরনের ক্ষতিকর উপাদান যোগ করা হচ্ছে। আমরা যে দুধ পরম আস্থার সঙ্গে পান করছি, তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদানে ভরপুর। বছর দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বায়োমেডিক্যাল রিসার্স সেন্টারের সাবেক পরিচালক আ ব ম ফারুক বাজারের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত তরল দুধ নিয়ে গবেষণা করে জানান যে, এসব দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, সিসাসহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। এ নিয়ে অনেক হইচই হয়। তারপর সবকিছু আবার আগের মতো চলতে থাকে।
দেশে জনসংখ্যা, দুধের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এই চাহিদা মেটাতে একশ্রেণির মানুষের দুষ্টবুদ্ধিও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার অভিজ্ঞতা বলা যাক। এই দুই জেলায় প্রচুর দুধ উত্পাদন হয়। বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিদিন খামারি ও দুগ্ধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ লাখ লিটার দুধ কেনে। বাকি দুধ এখানে গড়ে ওঠা শত শত ছানা তৈরি কারখানা ও দেশের বিভিন্ন মিষ্টান্নভান্ডার কেনে। এখানে নকল দুধ তৈরির কারখানাও গড়ে উঠেছে। নকল দুধ প্রস্তুতকারীরা ছানা তৈরি কারখানা থেকে উচ্ছিষ্ট ছানার পানি কিনে নিয়ে যায়। তারা এই ছানার পানির মধ্যে সয়াবিন তেল, রং ও বিশেষ রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করে। এগুলো আসল দুধের চেয়েও ধবধবে, সুন্দর। সেগুলো তারা বিভিন্ন কোম্পানিতে সরবরাহও করে। ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে মাঝেমধ্যে এমন নকল কারখানাকে জরিমানা করে। দু-চার জনকে জেল দেয়। কিন্তু মধুর স্বাদ পাওয়া অনিয়মের মৌমাছিরা নানা ফিকিরে ঠিকই জয়যাত্রা অব্যাহত রাখে।
এমন ভেজালযুক্ত ‘তৈরি দুধের’ পাশাপাশি আসল গরুর দুধেও নানা ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘হাইব্রিড’ গরু থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। এগুলো অনেকটাই ‘করপোরেট গরু’। এগুলোকে দুধ উত্পাদনের মেশিনও বলা যায়। সর্বোচ্চ পরিমাণ দুধ প্রদানের জন্য এগুলোকে যথাযথভাবে তৈরি করা হয়। এই গরুগুলোকে যে খাবার খাওয়ানো হয়, কৃত্রিম প্রজনন বা যে ইনজেকশন দিয়ে গর্ভবতী বানানো হয়, সুস্থ রাখতে অত্যন্ত শক্তিশালী যে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, তাতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অনেক উপাদান গরুর রক্ত-মাংস-দুধেও মিশে যায়। এদের নিয়মিত ভিটামিন-ওষুধ, গ্রোথ হরমোন আরো কত কী দেওয়া হয়। বেশি বেশি দুধ পেতে দেওয়া হয় বিশেষ খাবার। আমরা তো গরুর দুধ পেয়েই খুশি; কিন্তু এই দুধে কত ক্ষতিকর উপাদান মিশে আছে, তার খবর আমরা কজন রাখি?
যেখানে নিরাপদ ও খাঁটি দুধের চরম আকাল, সেখানে যারা গরুর দুধ দিয়ে গোসল করে ‘পবিত্র’ বা ‘নিষ্কলঙ্ক’ হতে চাইছেন, তাদের স্বার্থ কতটা সিদ্ধি হচ্ছে? ভেজাল দুধ দিয়ে গোসল করে কি কখনো ‘পবিত্র’ বা ‘নিষ্কলঙ্ক’ হওয়া যায়? আসলে আমাদের দেশের মনের মধ্যেই রয়েছে নানা ‘পাপ’। আমাদের দেশের মানুষের নেতিবাচক ভাবনা নিয়ে পরিশেষে একটি পুরোনো গল্প।
এক রাজা একবার একটি দুধের পুকুর বানাতে চাইলেন। তার লোকদের দিয়ে তিনি একটি পুকুর খনন করলেন। পুকুর খনন শেষ হলে রাজ্যে ঘোষণা দেওয়া হলো, সেদিন রাতেই যেন সবাই তাদের বাড়ি থেকে এক পাতিল করে দুধ নিয়ে এসে সেই পুকুরে ঢেলে দেয়।
রাজা সকালবেলা তার প্রাসাদের বারান্দা থেকে দুধের পুকুর দেখতে চান।
সবার কাছে রাজার এই নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া হলো। এক লোক ভাবল যে, সবাই তো পাতিলে করে দুধ নিয়ে যাবে, সে যদি রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে দুধের জায়গায় পুকুরে এক পাতিল জল দিয়ে আসে তবে কেউই তা বুঝবে না।
তাই সে সবার সঙ্গে গিয়ে সবার অলক্ষে এক পাতিল জল ঢেলে দিয়ে এলো।
সকালবেলা রাজা তার প্রাসাদের বারান্দায় এসে হাহাকার করে উঠল। তার সাধের পুকুর পানি দিয়ে ভর্তি, সেখানে এক ফোঁটা দুধও নাই। আসলে সবাই ভেবেছিল যে, আমার আর দুধ নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, অন্যরা তো পুকুরে দুধ ঢালবেই!
লেখক : রম্যরচয়িতা