দেশের চলমান বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে একটি নির্দিষ্ট খাতের ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা দেড় লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। বস্ত্র খাতের এ বিনিয়োগে ব্যাংকের অংশগ্রহণ আছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ।
উদ্যোক্তারা বলছেন, তাদের কারখানাগুলো মূলত চলে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস দিয়ে। গ্যাসের অভাবে তাদের জেনারেটর চলে না। আবার বিদ্যুতের আসা যাওয়ার কারণেও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সংকটের কারণে বিদ্যুৎ বিভাগ প্রথমে রেশনিং প্রথা চালু করে। এখন সে রেশনিং ওপর আবার যোগ হেয়েছে লোডশেডিং। যার কারণে বস্ত্র খাতের কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে উদ্যোক্তাদের পক্ষে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবেই না, উপরন্তু কারখানাগুলো রুগ্ণ হয়ে পড়বে। শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ছাঁটাইয়ের ফলে বেকারত্ব বাড়বে।
সাভার, গাজীপুর, নারয়ণগঞ্জ প্রভৃতি এলাকার কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বিকাল ৫টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত এসব এলাকায় গ্যাসের চাপ শূন্য। দিনে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না কারখানায়। দিনের অধিকাংশ সময় দুই থেকে তিন পিএসআই চাপ থাকে। যা থাকার কথা ছিল ৫ থেকে ১০ পিএসআই। এর ওপর বিদ্যুৎ রেশনিংয়ের ওপর লোডশেডিং চালু করায় সবার অবস্থা এখন ত্রাহি।
- বস্ত্র খাত : অর্থনীতির ব্যারোমিটার
বাংলাদেশের বস্ত্রখাতের পণ্যকে উদ্যোক্তারা দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হচ্ছে স্থানীয় এবং অপরটি হচ্ছে রপ্তানিযোগ্য। তবে এ খাতের শিল্পগুলো রপ্তানি পণ্যে মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখছে। গত অর্থবছরে (২০২০-২০২১) বাংলাদেশের রপ্তানিতে মোট ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মূল্য সংযোজন করেছে বস্ত্র খাতের কারখানাগুলো। এর মধ্যে নিটওয়্যার খাতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের হার ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। ওভেন এবং ডেনিম মিলিয়ে মূল্য সংযোজনের হার ৪৫ শতাংশের ওপরে। বস্ত্র কারখানাগুলো রপ্তানিতে অবদান রাখার পাশাপাশি স্থানীয় চাহিদাও পূরণ করছে। গত অর্থবছরে মোট ৭ বিলিয়ন মিটার কাপড় কারখানাগুলো স্থানীয় বাজারে জোগান দিয়েছে।
- পূর্ণ সক্ষমতায় যাচ্ছে না উৎপাদন
বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের অভাবে বস্ত্রকলগুলো তাদের সক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) হিসাব মতে, বর্তমানে সারা দেশের কারখানাগুলো গড়ে তাদের সক্ষমতার ৫০ শতাংশ উৎপাদন করতে পারছে। বিভিন্ন অর্ডার সময়মতো ডেলিভারি দেওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে পড়েছে। বিটিএমএর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন ইত্তেফাককে বলেছেন, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের অভাবে কারখানাগুলো পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় নানামুখী সমস্যায় পড়েছেন উদ্যোক্তারা। উৎপাদন কম হওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে। ক্রমাগত লোকসান দেবে কারখানাগুলো। উৎপাদন কমে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, এ খাতে ১০ লাখের বেশি লোক কাজ করে। অবস্থা এমন চলতে থাকলে অনেকে চাকরি হারাবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ যখন রেশনিং ব্যবস্থা চালু করে তখন আমরা তা মেনে নেই। কারণ তখন আমরা জানতাম কখন বিদ্যুৎ থাকবে, আর কখন থাকবে না। কিন্তু রেশনিংয়ের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে লোড়শেডিং।
- ছোট ও মাঝারি বস্ত্রকলের অবস্থাও ভয়াবহ
সিরাজগঞ্জ, পাবনা, আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, পলাশ, কালিবাড়ী, মাদবদী প্রভৃতি এলাকায় অনেক ছোটখাটো বস্ত্রকল রয়েছে। এখানকার মানুষের জীবনজীবিকা তাঁতনির্ভর। এসব জায়গায় অবস্থিত কারখানাগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। মোটের ওপর বিদ্যুৎ দিয়ে চলে কারখানাগুলো। অতিরিক্ত পুঁজির অভাবে তাদের জেনারেটর কেনা হয় না। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় তাদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার মতো নয় বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে ডায়িংয়ের সময় তারা সমস্যায় পড়ে বেশি। এক বার বিদ্যুৎ গেলে রং এবং রসায়নগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের কারণে সাইজিং মেশিন (মাড় দেওয়ার মেশিন) বন্ধ হয়ে গেলে সুতাগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং সেগুলো ফেলে দিতে হয়। এত এসব কারখানাগুলো প্রতিনিয়ত লোকসান গুনছে। অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন।
- হুমকির মুখে ব্যাংকের বিনিয়োগ
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বস্ত্রখাতের এখন মোট বিনিয়োগ দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই বিভিন্ন ব্যাংকের বিনিয়োগ। কারখানাগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় ক্রমাগত লোকসানের কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেক শিল্প ইতিমধ্যে রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বস্ত্র খাতে আগামী বছরের মধ্যে আরো আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিয়োগ আসছে। আমরা যদি জ্বালানির নিশ্চয়তা দিতে না পারি তাহলে তারা তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব ফিরিয়ে নেবে।
এদিকে, ব্যাংক থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) টাকা নিয়েও বিপাকে আছেন উদ্যোক্তারা। সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে না পারায় অনেকে নির্ধারিত সময়ে ইডিএফের অর্থ পরিশোধ করতে পারছেন না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর অবস্থা নিয়েছে। নির্ধারিত সময়ে এই অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে এই ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা হারাবেন উদ্যোক্তারা।
- বিনিময় হারের তারতম্য আরেক চিন্তার কারণ
টাকার সঙ্গে মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের তারতম্য উদ্যোক্তাদের আরেকটি চিন্তার কারণ। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংক যখন উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়েছিল তখন প্রতি মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকগুলো এলসি করছে ১০৭ টাকা দরে। এই বিশাল তারতম্যের কারণে উদ্যোক্তাদের লিমিট শেষ হয়ে যাচ্ছে আগেই। নতুন করে লিমিট না বাড়ানোয় অনেকে এলসি খুলতে পারছেন না। বিটিএমএ সভাপতির মতে, এমনিতে আন্তর্জাতিক কারণে আমরা নানা চাপের মধ্যে আছি। দীর্ঘকালীন করোনা অভিঘাত আমাদের কাবু করেছে। এর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় জ্বালানির অভাবে যদি আমরা কারখানা চালাতে না পারি তাহলে ভবিষ্যৎ কী হবে তা সময় বলে দেবে।