দেশের মধ্যে টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেই গত ৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন লিজ ট্রাস। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টিকলেন মাত্র ৪৫ দিন। নজিরবিহীন চাপের মুখে গতকাল বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) লন্ডনে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে দাঁড়িয়ে পদত্যাগের কথা জানান লিজ ট্রাস। দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে লিজ ট্রাসই হচ্ছেন সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী।
ব্রিটেনের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থায় মধ্যে লিজ ট্রাস দেশটির হাল ধরেন। অনেকের মধ্যে তখনই প্রশ্ন ছিল ট্রাস কী ব্রিটেনকে এই ‘ভঙ্গুর’ অবস্থা থেকে টেনে তুলতে পারবেন। ইউক্রেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাহিনীর আগ্রাসনের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর ‘সিরিজ’ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে করে জ্বালানি তেলের যে মূল্যে যে ঊর্ধ্বগতি তাতে যুক্তরাজ্যের ওপর বিরাট প্রভাব পড়ে। লিজ ট্রাস তার দলীয় ভোটের প্রচারণার সময় দেশে জ্বালানির দামে সীমিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। এই প্রতিশ্রুতি পূরণে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেন ট্রাস।
এই পরিকল্পনার মধ্যে একটি হচ্ছে কর কমানো, ধনীদের জন্য কর কমিয়ে বিনিয়োগে তাদের উৎসাহী করা। দেশটির নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রেও একই পরিকল্পনা কাজে লাগবে বলে বিশ্বাস লিজের।
পরবর্তীতে লিজ ট্রাসের ঘনিষ্ঠ প্রথম অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্তাং কয়েক সপ্তাহ আগে লিজের ওই পরিকল্পনাগুলোই একটি সংক্ষিপ্ত বাজেটের মাধ্যমে উত্থাপন করেন। এতে ব্যাপক কর ছাঁটাইয়ের কথা ছিল। কিন্তু এর জন্য অর্থসংস্থান করতে সরকারকে হাজার হাজার কোটি পাউন্ড ঋণ নিতে হতো।
কোয়াসির এই বাজেট উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই দেশটির মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম পড়তে শুরু করে। বিনিয়োগকারীদের সরকারি বন্ড ছেড়ে দেওয়ার হিড়িক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি। এতে ব্রিটেনের অর্থনীতির সংকট মাত্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এক গুরুতর চেহারা নেয়। এরপরেই এক প্রকার বাধ্য হয়ে কোয়াসিকে পদত্যাগ করাতে বাধ্য হন ট্রাস।
পরবর্তীতে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে জেরেমি হান্টকে নিয়োগ দেন লিজ ট্রাস। গত সোমবার জেরেমি হান্ট ট্রাসের অনেক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাতিলের ঘোষণা দেন। যার মধ্যে ট্রাসের মোট ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড কর ছাড়ের পরিকল্পনার বেশির ভাগই বাতিল হয়েছে। এতে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। তবে এরই মধ্যে কনজারভেটিভদের মধ্যে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে থাকে! ট্রাসের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যর্থ এবং পরিত্যক্ত হবার পর তিনি নিজে ক্ষমতায় থাকেন কী করে।
এরপর দুই-একজন করে কনজারভেটিভ এমপিরা ট্রাসের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করতে থাকেন। উঠতে থাকে ট্রাসের পদত্যাগের দাবি। ধীরে ধীরে এই পাল্লা ভারী হতে থাকে। লিজ ট্রাস প্রশাসন, দল এবং পার্লামেন্ট-সর্বত্রই তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা।
এমন অবস্থায় গত বুধবার লিজ ট্রাসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যানও পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে পার্লামেন্টে তেল অনুসন্ধানের জন্য ফ্র্যাকিংএর অনুমোদন দেওয়া সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি নিয়ে সরকারি দলের এমপিদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ থেকে প্রায় ধস্তাধস্তির উপক্রম হয়। গতকাল লিজের পদত্যাগ করার আগে অন্তত ১৩ জন টোরি এমপি প্রকাশ্যে অনাস্থা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। এরপরেই শেষমেশ নিজের গদি ছাড়ার কথা জানান লিজ।