সংবিধান অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার; কিন্তু শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষ এই অধিকার হইতে অধিক বঞ্চিত। কারণ এখানে স্বাস্থ্যসমস্যা প্রকট। যদিও গত পাঁচ দশকে গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোর প্রভূত উন্নয়ন হইয়াছে। যেমন—বর্তমানে আমাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চার শতাধিক (৪২১) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত প্রায় ৪ হাজার (৩ হাজার ৯০০টি) ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র, স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ১৩ শতাধিক (১ হাজার ৩১২টি) ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রহিয়াছে। রহিয়াছে স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং ইপিআই সেন্টার। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রহিয়াছে প্রাথমিক পর্যায়ের বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগ সেবা, রহিয়াছে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার; কিন্তু তাহার পরও গ্রামীণ মানুষ পাইতেছেন না কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা। কারণ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসা প্রদানে রহিয়াছে অবহেলা, উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনা এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় রহিয়াছে ব্যয়বৃদ্ধিসহ মান লইয়া নানা প্রশ্ন।
গত কয়েক দশকে দেশের যোগাযোগব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নয়ন হইয়াছে। পূর্বে যেইখানে নদনদী পার হইয়া রোগীকে উপজেলা বা জেলা সদর হাসপাতালে আনা ছিল কষ্টকর, এখন সেই অবস্থা আর তেমন নাই; কিন্তু ইহার পরও বিশেষত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলিতে ডাক্তার ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতিতে কোথাও কোথাও চিকিত্সাসেবা ব্যাহত হইতেছে। অ্যাম্বুলেন্স-সেবা প্রদান করা হইলেও কিছুদিন না যাইতেই তাহা অকেজো হইয়া পড়িতেছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় মেশিনারিজের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। সবচাইতে বড় সমস্যা হইল ডাক্তারের অনুপস্থিতি। সাম্প্রতিক কালে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হইলেও তাহাদের অনেকে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হইতে চাহিতেছেন না যাহা দুঃখজনক এবং আইন ও নিয়মের পরিপন্থি। তাহারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পোস্টিং লইয়া জেলা বা বিভাগে অবস্থান করেন এবং অনেক সময় বেসরকারি ক্লিনিকে যুক্ত হইয়া যান। এই বাস্তবতায় গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা সঠিকভাবে পালিত হইতেছে না। যাহারা গ্রামের মানুষকে চিকিত্সাসেবা প্রদানে অনাগ্রহী, তাহাদের সরকারি চাকুরি করিবার কী প্রয়োজন? এদিকে গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার প্রধান অবলম্বন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক; কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় নানা সমস্যায় জর্জরিত এই দুই কেন্দ্র। জনবলসংকট ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা তথা মনিটরিংয়ের দুর্বলতা রহিয়াছে। প্রতি ইউনিয়নে এক জন স্বাস্থ্য পরিদর্শকসহ তিন জন স্বাস্থ্যকর্মী থাকিবার বিধান থাকিলেও অধিকাংশ ইউনিয়নে পদ শূন্য। জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রতি ৩ হাজার জনসংখ্যায় এক জন পরিবার কল্যাণ সহকারী থাকিবার কথা। সেইখানেও শূন্যপদের ছড়াছড়ি। আবার বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবীদের স্বাস্থ্য সেক্টরে তৎপরতা পূর্বেকার অবস্থা হইতে সংকুচিত হইয়াছে। ফলে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় সার্বিকভাবে অনেকটা স্থবিরতা বিরাজ করিতেছে।
আমাদের মনে রাখিতে হইবে, দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করেন। তাহাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা এখনো নিম্ন পর্যায়ের। রোগ শয্যায় না পড়িলে সাধারণত তাহারা স্বাস্থ্যরক্ষায় তৎপর হন না। দেশের বৃহত্তর এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি না হইলে জনসম্পদের উন্নয়ন হইবে না। তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র এবং ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে দক্ষ জনবল নিয়োগ, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ডাক্তারদের অনুপস্থিতি কমানো, প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা এবং অকার্যকরগুলি কার্যকর করাসহ বিদ্যমান সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে। তাহা ছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক এই সিএইচসিপির পরিবর্তে আরো দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়া এবং কিছু ডিজিটাল টেস্টিং-সুবিধা প্রদান করিবার মাধ্যমে আমাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে আরো শক্তিশালী করিতে হইবে। আমরা মনে করি, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করিতে হইলে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করাটা সবচাইতে জরুরি। সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করিবার কারণে সরকারের করোনা টিকা প্রদানের কর্মসূচি সফল হইয়াছে। এই সমন্বয়ের পাশাপাশি পল্লি অঞ্চলের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়োজিত চিকিৎসক ও কর্মচারীদের আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। একসময় ঢাকাকে তিলোত্তমা নগর হিসাবে গড়িয়া তুলিবার ঝোঁক ছিল। এখন গ্রামীণ পর্যায়ের উন্নয়নের প্রতি আমাদের অগ্রাধিকার প্রদানের কোনো বিকল্প নাই।