ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর পার্লামেন্টে প্রথম প্রশ্নোত্তর পর্বে বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতার আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিলো ঋষি সুনাককে। যেখানে অর্থনৈতিক সংকটের জন্য শাসক দলের তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি নতুন সাধারণ নির্বাচনের দাবি উঠে এসেছে পরিষ্কার ভাবেই।
সুনাক-এর জবাবে বলেছেন, তার দল ভোটে জয়ী হয়েই ক্ষমতায় এসেছে বলে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের ম্যান্ডেট তার আছে এবং তিনি সবসময়ই জনগণের সুরক্ষায় কাজ করে যাবেন।
প্রায় ৫ বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির এমপিদের সমর্থনে দলের নেতা নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তিনি।
কিন্তু ব্রিটেনের রাজনীতির একজন বিশ্লেষক ড. মুশতাক খান বলছেন, সুনাকের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতাই হলো যে তিনি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত নন। একই সঙ্গে, তার দলের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে কম যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার কাজ চালিয়ে যাওয়া খুব একটা সহজ হবে না।
‘ঋষি সুনাকের জন্য কাজটা কঠিন এই কারণে যে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন পার্টির মধ্যে একটা বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। উনি কিন্তু জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হননি,’ বলছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ওনার দল জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। আবার দলের মধ্যেই তিনি একটি শাখার প্রতিনিধি। এই পার্টির মধ্যেও অনেক ভাগাভাগি হয়েছে। আবার দলটির জনপ্রিয় নেতা বরিস জনসনের পতনের জন্যও তার সমর্থকরা অনেকেই ঋষি সুনাককে ক্ষমা করবে না। অর্থাৎ ঋষি সুনাকের সমর্থনবর্গ খুবই সীমিত।
সুতরাং বিরোধী দল তো বটেই দলের মধ্যেই একাধিক শক্তিশালী বলয় আছে যারা সুনাককে পদে পদে বাধা দেবেন। দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে এখন তিনি জনপ্রিয় হলেও জনসনেরও পক্ষেও অনেকেই সক্রিয় আছেন এবং দলটির সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে বরিস জনসনের জনপ্রিয়তা হারিয়ে যায়নি।
এমনকি সদ্য সাবেক হওয়া প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে যারা সমর্থন করেছিলেন তাদের বড় একটি অংশও সুনাকের পক্ষে সক্রিয় নন। কাজেই নিরঙ্কুশ সমর্থন না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় কী ধরণের বাধা বিপত্তির মুখে তিনি পড়বেন এবং কীভাবে তা সামাল দিবেন সেটিও তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
আর ঋষি সুনাকের হাতে আগামী নির্বাচনের আগে সময় আছে মাত্র দু’বছরের মতো। তাই এ সময়ের মধ্যে জনমনে স্বস্তি আনা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে অস্থিরতা কমানোর কাজটা খুব একটা সহজ নাও হতে পারে।
ড. মুশতাক খান বলছেন, একদিকে দলের মধ্যে দুর্বল অবস্থান, আবার অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে তৈরি হওয়া প্রবল অর্থনৈতিক সংকট- এ দুটি সমস্যা সুনাক কীভাবে সামাল দেন সেটিও হবে দেখার বিষয়। কারণ কোথাও সুযোগ পেলেই দলের ভেতর ও বাইরে থেকে প্রবল চাপ ধেয়ে আসবে তার দিকে।
“উনি হচ্ছেন একজন দক্ষিণপন্থী অর্থনীতিবিদ, যিনি (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) মার্গারেট থ্যাচারকে তার মডেল বলে মনে করেন। থ্যাচারের মডেল অনুযায়ী, অর্থনীতির আয় ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে হলে তাকে কঠিনভাবে সরকারি ব্যয় কমাতে হবে। ফলে যেসব খাতে গরীবরা সরকারি সাহায্য পায় সেখানে খরচ কমলে সবচেয়ে বড় আঘাত আসবে গরীবদের ওপর।
“এটা ওনার জন্য সমস্যা, কারণ উনি ব্রিটেনের ধনী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য। ফলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে গরীবদের টাকা কমানো তার জন্য কঠিন হবে। কারণ, তার রাজনৈতিক সমর্থনও সীমিত।”
মুশতাক খান বলছেন, আগামী দু’মাসের মধ্যে বোঝা যাবে যে ঋষি সুনাক কতটা রাজনৈতিক পারঙ্গমতা এক্ষেত্রে দেখাতে পারেন।
এই মধ্যে, রাজনৈতিক অঙ্গনে বরিস জনসনের পতনের পর থেকেই ক্ষেত্রে লেবার পার্টি নতুন সাধারণ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। আবার একাধিক জরিপে কনজারভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তায় ধ্বসের খবর দিচ্ছে গণমাধ্যমগুলো।
দলের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা তার বিরোধী। এদের এক বৃত্তের ভেতরে ফিরিয়ে আনার কাজটা কখনোই সহজ বিষয় হবে না। আগের চার প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, টেরিজা মে, বরিস জনসন ও লিজ ট্রাসের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এসেছিলো দলের ভেতর থেকেই।
দলটির মধ্যে যে মাত্রায় বিভক্তি ও কোন্দল আছে তাতে করে পূর্ণ দলীয় সমর্থন নিয়ে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করাটাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। এই অবস্থায় দলকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে নেতৃত্ব দিতে মি. সুনাক কতটা রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেবেন তার ওপরই কার্যত নির্ভর করবে তার সরকারের স্থায়িত্ব, যেমনটি বলছিলেন যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. অ্যান্ড্রু বার্কলে।
“গত কয়েক বছর ধরে কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দলীয় কোন্দল চলছে। স্বাভাবিকভাবে মনে হচ্ছে, এই বিভেদের কারণে ঋষি সুনাকের দায়িত্ব অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়বে,” বলছেন তিনি, “দলের মধ্যে এখন ঐক্যের খুবই প্রয়োজন। বিশেষ করে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে দলের বিজয় টিকিয়ে রাখার জন্য এখন তারা জোরদার প্রচেষ্টা চালাতে চায়।
“ফলে ঋষি সুনাককে এমুহূর্তে দুটি সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। প্রথম সমস্যাটি রাজনৈতিক – জনমত জরিপে বিরোধী দল লেবার পার্টি এখন ৩০ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছে। এটা কনজারভেটিভ পার্টির জন্য মহাবিপর্যয়কর হতে পারে, যদি না আগামী নির্বাচনের আগে তারা দলের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে পারে।
“দ্বিতীয় সমস্যাটি অর্থনৈতিক। তার পূর্বসূরি প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে বেপরোয়া আচরণ করেছিলেন সে জন্যই তার পতন ঘটে। সুতরাং, ঋষি সুনাক যদি এই দুটি ক্ষেত্রে তার কাজে অগ্রগতি দেখাতে পারেন, তাহলে দল তার প্রতি সমর্থন জুগিয়ে যাবে।”
অন্যদিকে, দেশের বাইরে ব্রিটেনের জন্য বড় মাথাব্যথার বিষয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এর কারণে জ্বালানির দাম ইউরোপে বেড়ে গেছে, যা সামনে শীতের সময়ে আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সংকট আবার এসেছে করোনা মহামারির ধাক্কার পর।
দুটো মিলিয়ে ব্রিটেনের অর্থনীতি বিশাল চাপে পড়েছে এবং এর ফলে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে সবকিছুর দামই এখন সাধারণের আওতার বাইরে। কেউ কেউ ইতোমধ্যেই আশংকা প্রকাশ করেছেন যে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালের শুরুতে যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি ১৮ শতাংশও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
কিন্তু এর মধ্যেই প্রথম অশ্বেতাঙ্গ ও অভিবাসী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবারের সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন ঋষি সুনাক। এটা তাকে কোন রকম বাড়তি সুবিধা দেবে কি?
জবাবে অধ্যাপক অ্যান্ড্রু বার্কলে বলছেন, ঋষি সুনাক যে ব্রিটেনের প্রথম এশীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী, এটা হচ্ছে বাস্তবতা। সবগুলো দলের নেতারা তার নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে।
তিনি বলছেন, “তার নিয়োগ ব্রিটিশ রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের অগ্রগতির প্রমাণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এটা একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ যে তাকে নিয়োগ করেছে কনজারভেটিভ পার্টি, যার বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে উপেক্ষা করার অভিযোগ চলে আসছিল। একারণে ব্রিটিশ এশিয়ানদের একটা বড়ো অংশ এতদিন লেবার পার্টিকে ভোট দিয়েছে।
“তবে তার নিয়োগের মধ্য দিয়ে এটা বলাই যায় যে কনজারভেটিভ পার্টিতে দৃষ্টিভঙ্গির একটা পরিবর্তন গড়ে উঠেছে। ১৫/২০ বছর আগেও কনজারভেটিভ এমপিদের কাছ এই দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাওয়া বেশ কষ্টকর হতো।”
আলোচিত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সামাজিক সেবা খাতে পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করেও কোন সুফল দেখাতে পারেননি। বরং করোনা মহামারির সময় ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবার করুন চিত্রই অনেকটা প্রকাশ পেয়েছে। আর লিজ ট্রাস তেমন কোন কাজ দেখানোর সুযোগই পাননি। বরং গত দু বছরে জীবনযাত্রার ব্যয়, পরিবহন ব্যয় কিংবা বিদ্যুৎ বিল যেভাবে বেড়েছে সেভাবে মানুষের আয় বাড়েনি।
এমন সংকটের মধ্যে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে রাজনৈতিক নাটকীয়তায় ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অবশ্য আনন্দিত করেছে অভিবাসী বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে যাওয়া পরিবারগুলোর মানুষদের।
ব্রিটেন-ভিত্তিক বাংলা সংবাদপত্র পত্রিকার সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী বলছেন, অনেক চ্যালেঞ্জ আর অনিশ্চয়তা নিয়ে মি. সুনাক প্রধানমন্ত্রী হলেও ব্রিটেনের সংখ্যালঘু ও বঞ্চিতদের মধ্যে উৎসাহ সঞ্চার করেছেন।
“আমার মনে হয় একটা বড় চ্যালেঞ্জের কথা ভেবেই এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করেই ঋষি সুনাক দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি এ মূহুর্তে কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য নেতা হিসেবে প্রমাণিত। সাধারণ মানুষও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন যে একজন মানুষ নতুন উদ্যোমে সংকট মোকাবেলায় হাত দেবেন,” বলছেন তিনি।
“সুনাক প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার মধ্য দিয়ে এথনিক কমিউনিটি, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের, মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে।”
কিন্তু ভোটের ক্ষেত্রে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি কতটা প্রভাব তৈরি করতে পারবেন তার অনেকটাই নির্ভর করবে যে তিনি ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সংকট কতটা দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে পারেন।
বিশেষ করে তিনি নিজে ধনী ব্যক্তি, তাই তিনি সাধারণ মানুষের সমস্যা কতটা উপলদ্ধি করতে পারবেন এ নিয়ে তারা সন্দিহান। যদিও তিনি বলেছেন যে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে তিনি বদ্ধ পরিকর।
অন্যদিকে লেবার পার্টি ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিসহ ব্রিটেনের বিরোধীদলগুলো বলছে, ব্রিটেনের সমস্যার সমাধান প্রধানমন্ত্রী বদল করে হবে না, বরং এজন্য তারা চান নতুন সাধারণ নির্বাচন। ইতোমধ্যে কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে অনেক বছর পর জনপ্রিয়তায় বেশ এগিয়ে আছে লেবার পার্টি।
অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মি. সুনাক কেমন করেন সেদিকেও দৃষ্টি থাকবে সবার। তবে অনেকেরই ধারণা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একজন অশ্বেতাঙ্গ এবং অভিবাসী পরিবারের সন্তান মি. সুনাকের নির্বাচন ব্রিটেনের সমাজ এবং রাজনীতিতে এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।