ডলার সংকটে ধারাবাহিকভাবে কমছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গতকাল সোমবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের আমদানি বিল ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১৩০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারে (৩ হাজার ৪৪৭ কোটি ডলার)। আকুর দায় পরিশোধের আগে সোমবার দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার; যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী হিসাব হলে রিজার্ভের অঙ্ক নেমে দাঁড়াবে ২৬ বিলিয়ন ডলারে। এমন পরিস্থিতিতে আমদানি কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর ফলে গত সেপ্টেম্বরে আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে। সেপ্টেম্বরে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৬১৭ কোটি ডলারের। গত ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৭১০ কোটি ডলারের। এদিকে ডলার-সংকটের কারণে দেশের অনেক ব্যাংকই নির্ধারিত তারিখে এলসি দায় পরিশোধ করতে পারছে না। কোনো কোনো দায় পরিশোধে এক মাসও বিলম্ব হচ্ছে। এ অবস্থায় এলসির নিশ্চয়তা দেওয়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিদেশি অনেক ব্যাংকই এখন বাংলাদেশের জন্য নিজেদের ক্রেডিট লাইন কমিয়ে দিতে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ গতকাল বলেন, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে এটা অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এখন আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। প্রথমে আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। ডলারের রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছাকাছি দাম না দিলে রেমিট্যান্স বাড়বে না বলে মনে করেন সাবেক এ গর্ভনর। তবে আমদানি বন্ধ করে রিজার্ভ বাড়ানো যাবে না। যেসব পণ্য দরকার, তা আমদানি করতে হবে। তা না হলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
উল্লেখ্য, ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ঐ বছরের ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এর পর তা বেড়ে গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার হয়। এরপর থেকে গত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রিজার্ভ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। রেমিট্যান্স বাড়ানো জরুরি। এর জন্য কী করণীয় সরকারের তা ভাবতে হবে। আরো প্রণোদনা দেবে নাকি বিদেশে শ্রমবাজার বাড়াবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অনেক আগে থেকেই আমরা বলছি বিলাসপণ্য আমদানি বন্ধ করতে। কিন্তু আমাদের কথা আমলে নেওয়া হয়নি। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে রিজার্ভ এত কমত না। এর পাশাপাশি আমরা এখনো বলে চলেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রি বন্ধ করা উচিত। কিন্তু তা কর্ণপাত না করে ডলার বিক্রি আরো বেড়েই চলেছে। খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন আইএমএফ রিজার্ভের যে হিসাব পদ্ধতির কথা বলছে তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা। আমরা চাইলেই আমাদের রিজার্ভের হিসাব যে কোনোভাবে করতে পারি না। রিজার্ভকে আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে আমাদেরকে মাপতে হবে।