প্রতিটি দেশের নিজস্ব মুদ্রা রয়েছে। আমাদের যেমন টাকা, যুক্তরাষ্ট্রের তেমনি ডলার। কিন্তু টাকা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় না, এজন্য প্রয়োজন ডলারের। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ডলারে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করে। অর্থাৎ, কোনো পণ্য আমদানি করলে তার বিল মেটায় ডলারে, আবার কোনো পণ্য রপ্তানি করলে তজ্জন্য অর্থ পায় ডলারে।
মার্কিন কংগ্রেস ১৭৮৫ সালে এটি প্রবর্তন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘হার্ড কারেন্সি’ হিসেবে পরিগণিত হয়। এটি বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত মুদ্রা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও কিছু দেশ ডলারকে সরকারি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করে। তবে সেগুলোর মূল্যমান আলাদা। মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক ব্যবহার দুই ধরনের। প্রথমত এটি আন্তর্জাতিক দেনা-পাওনা মেটানোর মুদ্রা। দ্বিতীয়ত এটি বহুল প্রচলিত একটি ‘রিজার্ভ কারেন্সি’। তবে ইউরো প্রচলনের পর থেকে মার্কিন ডলারের প্রভাব ধীরে ধীরে কিছুটা কমতে শুরু করে।
বিশ্ব জুড়ে ডলারকে বলা হয় ‘রিজার্ভ মুদ্রা’। ‘রিজার্ভ মুদ্রা’ বা ‘বৈশ্বিক মুদ্রা’ হচ্ছে এমন একটি মুদ্রা, যেটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত এবং যে মুদ্রাকে রাষ্ট্রগুলো সঞ্চয় করে রাখে। বিশ্বে যত লেনদেন হয়, তার ৮৫ ভাগ হয়ে থাকে ডলারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুসারে, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভের প্রায় ৬২ শতাংশই মজুত আছে ডলারে। বাকি অংশের মধ্যে ২০ শতাংশ আছে ইউরোতে। জাপানের ইয়েন ও ব্রিটিশ পাউন্ডে সংরক্ষিত আছে প্রায় ৫ শতাংশ করে রিজার্ভ।
ডলারের আগে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ছিল ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের। ১৯২০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছে এই মুদ্রা। মূলত ডলার আসার আগে ৫০০ বছর ধরে যেসব মুদ্রা রাজত্ব করেছে, তার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের মুদ্রা। বিশ্বের নানা প্রান্তে এসব দেশের কলোনি থাকায় তাদের মুদ্রাও বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনসহ বেশির ভাগ দেশ অনেকটা বাধ্য হয়েই ‘স্বর্ণমান’ থেকে সরে আসে। তখন থেকে এসব দেশের মুদ্রা সোনার মানের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। মুদ্রার মানকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন সোনার মান আর নির্দিষ্ট থাকেনি। চাহিদা আর জোগানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পণ্যের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়, এমন মুদ্রাকে বলা হয় ফিয়াট মানি।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন ছিল বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি। তাদের স্বর্ণের মজুত ছিল সবচেয়ে বেশি। তখন লন্ডন ছিল বিশ্ব ব্যাংকিংয়ের কেন্দ্র। ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিং ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহুল ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। ১৮৭০ দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়। বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপীয় দেশগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক সংগ্রামে লেগে যায়। অন্যদিকে যুদ্ধের ব্যয় বহন করার জন্য দেশগুলো তাদের স্বর্ণ মজুতের বিপরীতে যে পরিমাণ মুদ্রা ছাপানো যেত, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কাগুজে নোট ছাপাতে শুরু করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেয় আড়াই বছর পরে। সেই অর্থে যুদ্ধের আঁচড় দেশটির গায়ে লাগেনি। যুদ্ধের প্রথম তিন বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরতে রেখে; ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে সামরিক সরঞ্জাম ও রসদপত্র রপ্তানি করে নিজেদের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। এই সময়ও যুক্তরাষ্ট্র তার রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদির বিনিময়ে সোনা ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। আর এই নীতির ফলে তাদের স্বর্ণমজুত ফুলেফেঁপে ওঠে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুতকৃত সোনার ৭০ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত ছিল। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসতে আসতে বিশ্বের মোট মজুত সোনার একটি বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারে জমা হয়। অন্যদিকে ইউরোপ তখন ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। মানুষের হাতে কাজ নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণী হয়ে প্রচুর স্বর্ণ হারিয়ে ফেলে। ফলে তাদের পক্ষে নিজ নিজ মুদ্রার বিপরীতে সোনা মজুত করে রাখা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডসে ৪৪টি ধনী দেশ জাতিসংঘের মুদ্রা ও আর্থিক সম্মেলনে মিলিত হয়ে একটি চুক্তি সম্পাদন করে। ব্রেটন উডস চুক্তি একটি নতুন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার মাধ্যমে স্বর্ণকে সর্বজনীন মান হিসেবে ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট মুদ্রা বিনিময় হার তৈরি করা যায়। চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয় যে, যেহেতু বিশ্বের অধিকাংশ স্বর্ণের রিজার্ভ আমেরিকার হাতে এবং স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে ডলার স্থিতিশীল ছিল। সেজন্য ৪৪ দেশ ডলারকে তাদের রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে রাখতে সম্মত হয়। বাকি সব মুদ্রা ডলারের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখবে। অর্থাৎ এসব দেশের মুদ্রার বিনিময়মূল্য নির্ধারিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের ওপর ভিত্তি করে। আর ডলারের মূল্য নির্ধারিত হয় তখন সোনার ওপর ভিত্তি করে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুত করা সোনার ৭০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিপুল সোনা মজুত এবং ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় সেসব দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ কারেন্সি (মুদ্রা) হিসেবে ডলার সংরক্ষণে একমত হয়। মূলত ডলারের আধিপত্য সেই থেকে শুরু।
বিশ্ব জুড়ে আমেরিকান ডলারের কর্তৃত্ব ধরে রাখা, ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি এবং ১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে তীব্র উত্তেজনার কারণে ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পন্ন হয়। এতে বলা হয়, সৌদি আরব থেকে বিশ্বের যেসব দেশ জ্বালানি তেল আমদানি করবে, তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারে। বিনিময়ে সৌদি আরবকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র। এর দুই বছর পর ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক সৌদি আরবের মতোই সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ তেল বিক্রির সব অর্থ পরিশোধ করতে হবে শুধু ডলারে।
এই চুক্তি অনুযায়ী সৌদি আরবকে বাধ্য করা হয়েছে ডলারকে সার্বভৌম বিশ্বমুদ্রা হিসেবে মেনে নিতে। সৌদি মুদ্রার বিনিময় হার ১ ডলার = ৩ দশমিক ৭৫ সৌদি রিয়াল বেঁধে দেওয়া হয়। অর্থাৎ সৌদি অর্থনীতির যে অবস্থাই থাকুক, আমেরিকার হস্তক্ষেপের কারণে ডলার ও রিয়ালের এই হার ওঠানামা করে না। উল্লেখ্য, সৌদি ছিল একক সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনকারী দেশ। সুতরাং সৌদি আরবের চুক্তির কারণে অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশকেও এই চুক্তি মেনে নিতে হয়েছে। সে মাফিক, ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন, অর্থাৎ অন্যান্য দেশগুলো সৌদি আরবের মতোই সিদ্ধান্ত নেয়। তেল হলো একটি পণ্য, যা সব দেশের প্রয়োজন এবং আমদানি করতে হয় মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ডলারের মাধ্যমে। ফলে, প্রকারান্তে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সব ব্যবসায়-বাণিজ্য যেন ডলার ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রায় না চলে, তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; হয়েছেও তাই। আমেরিকা সব সময়ই নিশ্চিত করতে চেয়েছে যেন কোনো দেশ এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে না যায়।
আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭১ সালে সবাইকে অবাক করে ঘোষণা করল তারা আর ব্রিটন উডস সিস্টেম মানবে না, ডলারের বিপরীতে সোনার মজুত ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে, অর্থাৎ সোনার ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না, যা ‘নিক্সন শক’ নামে পরিচিত। স্বর্ণের দাম হবে অনির্দিষ্ট। মানে মার্কেট অটোম্যাটিকালি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করবে। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ডলার হয়ে গেলে ফিয়াট ভাসমান মুদ্রা, তখন থেকে গোল্ডের ওপর কোনে ডিপেন্ডেন্সি নেই। ডলার থেকে স্বর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে গেল। আর এভাবেই বিশ্বব্যাপী মার্কিন ডলার একক ও অভিন্ন মুদ্রা হয়ে উঠল।