বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একটি প্রস্তাব নিয়ে গত মাসে অগ্রসর হয়েও সরকার পিছিয়ে এসেছিল। এখন আবার মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী দাম বাড়ানো হলে এ খাতের ভর্তুকি কিছুটা কমবে।
সরকার বাজেট সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে।
৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের জন্য এরই মধ্যে প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছে। সেখানে আইএমএফ ভর্তুকি সংস্কারের জন্য বলেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকার সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে বাড়বে মূল্যস্ফীতিও। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি আছে। এর নেতিবাচক প্রভাবে খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণে সমঝোতা করতে হচ্ছে মানুষকে।
গত রবিবার পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) রিভিউ আবেদন করেছে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। আবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিইআরসির সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বিপিডিবি আমাদের কাছে একটি রিভিউ আবেদন পাঠিয়েছে। সেটি গত ১৩ নভেম্বর বিকেলে বিইআরসি গ্রহণ করেছে। ’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কমিশনের আদেশের বিষয়ে কারো আপত্তি থাকলে তাঁরা ৩০ দিনের মধ্যে কমিশনে রিভিউ আবেদন করতে পারেন। বিপিডিবি নির্ধারিত ৩০ দিনের মধ্যেই রিভিউ আবেদন দিয়েছে। ’
বিপিডিবির রিভিউ আবেদনে কি নতুন করে আবার গণশুনানির প্রয়োজন হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে বজলুর রহমান বলেন, ‘বিপিডিবির আবেদন দেখার পর যদি কমিশন মনে করে গণশুনানির প্রয়োজন, তাহলে গণশুনানি হবে। আর যদি মনে করে গণশুনানির প্রয়োজন নেই, তাহলে শুনানি হবে না। এটি বিপিডিবির আবেদনের ওপর নির্ভর করছে। ’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিইআরসিতে আবেদন দেওয়ার আগে বিপিডিবি সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে অনুমোদন নিয়েছে। ’
গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি সরকারের জন্য এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তিন খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের বাড়তি দামের কারণে বিদ্যুতে ভর্তুকি এমনিতেই বাড়ছে। গত পাঁচ মাসে শুধু বিদ্যুৎ খাতেই অর্থ মন্ত্রণালয় ৯ হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে। এটি চলতি অর্থবছরে এ খাতের মোট বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
আইএমএফ এ খাতের বাড়তি ভর্তুকি সমর্থন করে না। সংস্থাটি মনে করে, সরকারি-বেসরকারি ৯০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেওয়া ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়ছে। এ অর্থ দিয়ে সরকার অন্য কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে।
এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এবার যে রাজস্ব আয় হচ্ছে তা দিয়ে ভর্তুকি ব্যয়ের চাপ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ ছাড়া আইএমএফ ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের আগে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা বলেছে। তাই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে এর জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
গত বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার ঘোষণা দেন। ওই দিন আইএমএফের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান রাহুল আনন্দও একই বিষয়ে পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেন। আগামী জানুয়ারিতে এই ঋণ আইএমএফের বোর্ডে পাস হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে অনুমোদন পেলে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৪৭.৪৮ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাবে।
এই ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কিছু করণীয় বা শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে বাংলাদেশকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব শর্তের মধ্যে ভর্তুকি কমাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অন্যতম। শর্ত বাস্তবায়িত না হলে অর্থছাড়ে বিলম্ব হতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েক অর্থবছর আগেও ভর্তুকিতে বরাদ্দ ৫০ হাজার কোটি টাকার নিচে ছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘আইএমএফ বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি কামনোর কথা বলেছে, সম্পূর্ণ ওঠানোর কথা বলেনি। এটি ইতিবাচক। ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে এখন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক—সব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ’ তিনি বলেন, শর্ত পূরণের জন্য আইএমএফ যতটুকু ভর্তুকি কমাতে বলছে ততখানি না হলেও মাঝামাঝি কিছু একটা করবে সরকার। কারণ দেশ এমনিতেই অর্থনৈতিক চাপে আছে।
পাইকারি দাম কত বাড়ানোর প্রস্তাব
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়। দাম ইউনিটপ্রতি পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে আট টাকা ৫৮ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়। কমিশনের গণশুনানি হয় ১৮ মে। গণশুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি ভর্তুকি বাদে ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে।
বিপিডিবির যুক্তি ছিল, বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি খরচ হচ্ছে ৯ টাকার বেশি। এতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিডিবির লোকসান হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিপিডিবি বিদ্যুতের বর্তমান দর ইউনিটপ্রতি পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে আট টাকা ৫৮ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়।
অবশ্য আইএমএফের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসার আগে গত জুনে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ২৩ শতাংশ ও এলএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করা হয়। এ ছাড়া আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের দাম ৪৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপ ও মানুষের জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় বিইআরসি মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
পাইকারিতে বাড়লে গ্রাহক পর্যায়ে বাড়বে
দেশে বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা বিপিডিবি। বিপিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহক বা খুচরা পর্যায়ে বিতরণ করে দেশের পাঁচটি কম্পানি। এগুলো হলো ডেসকো, ডিপিডিসি, আরইবি, নেসকো ও ওজোপাডিকো। বিপিডিবিও পাইকারি বিদ্যুৎ বিক্রির পাশাপাশি দেশের কিছু এলাকায় সরাসরি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। বিতরণকারী কম্পানিগুলো বলছে, পাইকারিতে দাম বাড়লে অবশ্যই খুচরা পর্যায়েও বাড়বে।