চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের বড় আলোচনার বিষয় ছিল বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া। কিন্তু গত পাঁচ মাসে এক জন করদাতাও ৭ শতাংশ কর দিয়ে টাকা বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আনেননি। এমনকি এই সুযোগ ব্যবহার করে বিদেশে বৈধভাবে গচ্ছিত টাকাও দেশে আসেনি। তখন নীতিনির্ধারকরা প্রত্যাশা করেছিলেন, এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অনেকেই দেশে টাকা আনবেন। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এই সুযোগ কেউ নেননি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে বলেছি কেউ পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনবেন না। যে টাকা বের হয়ে যায় সে টাকা আর আসে না। এ সুযোগ দেওয়াটাই নৈতিকভাবে ঠিক হয়নি। আবার এ সুযোগ থেকে আমরা যে কিছু পাব, সে আশা করাটা ছিল দুরূহ। আমরা বলেছিলাম কিছু পাওয়া যাবে না। এতে আমাদের বদনাম হবে, সেটাই হয়েছে। আমরা নৈতিকতাবর্জিত সুযোগ দিয়েছি, তাতে কিছুই লাভ হয়নি আমাদের।’
তবে এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মেয়াদের শেষ দিকে সাধারণত এ ধরনের সুযোগ করদাতারা বেশি নেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে তারা মনে করেন। গত ১ জুলাই থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত, অর্থাৎ এক অর্থবছরের জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে অর্থ আনলে ৭ শতাংশ কর দিয়ে তা কর নথিতে দেখালেই বৈধ হয়ে যাবে, এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগ নিলে এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা এই বিষয়ে প্রশ্ন করবে না। পাশাপাশি বিদেশে সম্পদ বা অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি হিসেবে সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করার ক্ষমতা কর কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে। তবে শর্ত নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। এই বিধান চালুর এক মাস সাত দিন পর গত ৭ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বিদেশ থেকে অর্থ এনে কর নথিতে দেখানোর ব্যাখ্যা দেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
তিনি জানিয়েছেন, কালো টাকা নয়, বিদেশে থাকা বৈধ টাকা দেশে এনে কর নথিতে দেখানো যাবে। এর এক দিন পরই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি আদেশ জারি করে। ৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের চিঠি লিখে জানায়, ৭ শতাংশ কর দিয়ে বাংলাদেশের বাইরে যে কোনোরূপে গচ্ছিত ও অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধভাবে দেশে এনে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করা যাবে। যেহেতু ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ঐ অর্থ দেশে আসবে, সেহেতু কোথাও প্রশ্ন করার সুযোগ নেই যে, ঐ অর্থ বিদেশে বৈধ, নাকি অবৈধভাবে গচ্ছিত ছিল। তবে বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বিধিনিষেধ আছে। এসব বিধিনিষেধের কারণে অনেকেই উত্সাহী হন না।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়েছে। আর এ কারণেই তা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক দেশ এমন উদ্যোগ নিয়ে সফলও হয়েছে। এসব অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বাধা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার চাইলেই এই টাকা ফেরত আনতে পারবে না। এর জন্য আন্তর্জাতিক আইন আছে, দেশে আইন আছে। সেই আইনে অর্থ পাচার গুরুতর অপরাধ। সেই আইন মেনেই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে পাচারের অর্থ ফেরত আনতে হবে। বাংলাদেশেও এর উদাহরণ আছে। সিঙ্গাপুর থেকে আইন মেনেই পাচারের অর্থ ফেরত আনার নজির আছে। কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’, সিঙ্গাপুরে তারকা হোটেল গড়ে তোলা, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের সম্পদ এখন বহুল আলোচিত বিষয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।