কক্সবাজারের টেকনাফে আত্মসমর্পণ করা ১০২ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবাকারবারির বিরুদ্ধে দায়ের ইয়াবা ও অস্ত্রের পৃথক দুটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলা থেকে সবাইকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন আদালত। তবে, ইয়াবা মামলায় প্রতিজনকে এক বছর ৬ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থ দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। মামলার এজাহার ও সাক্ষ্যে গরমিল থাকায় আত্মসমর্পণের দিন উপস্থাপন করা বন্দুকের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে মামলার বাদী। রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা এ তথ্য জানিয়েছেন। বুধবার (২৩ নভেম্বর) বেলা পৌনে ২টার দিকে রায় ঘোষণা করেন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
আত্মসর্মণের পর প্রতি আসামি একবছর নয় মাস করে বিনাশ্রমে কারাগারে ছিলেন। সে হিসেবে তাদের ইয়াবার সাজা আর ভোগ করতে হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিচার সংশ্লিষ্টরা। দেড় বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা ২১ মাস বিনাশ্রমের সঙ্গে সমন্বয় করা হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। তবে, আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা নিষ্পত্তির স্বার্থে সব আসামিকে কারাগারে যেতে হবে। সেখানে অবস্থানকালীন সময়ে আদালতের রায়ের কপি, জরিমানা সব কিছু উপস্থাপনের পর তারা পূর্ণ মুক্তি পাবেন।
কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপার (তত্ত্বাবধায়ক) মো. শাহ আলম খান বলেন, যেহেতু তারা আগে কারাভোগ করেছেন সেহেতু সে সময়গুলো সাজার সঙ্গে গণনা হতেই পারে। তবে, এসব বিষয় আদালত রায়ে যেভাবে লিখবেন সেভাবেই গণ্য হবে। তাই রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত সবকিছু বলা সম্ভব নয়। আমার তত্ত্বাবধানে এ মামলায় ১৭ জন রয়েছেন।
বুধবার বেলা ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে আসামিদের আদালতে আনা হয়। পৌনে একটা থেকে রায় পাঠ শুরু করেন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। রায় উপস্থাপনের পর বেলা পৌনে ২টার দিকে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। এসময় আগে কারাগারে থাকা ১৭ আসামি উপস্থিত থাকলেও বাকি ৮৪ জন ছিলেন অনুপস্থিত। রায়ে সাজা হবে বুঝতে পেরে তারা আগে থেকে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। গত ১৪ নভেম্বর সাক্ষীর জেরা ও ১৫ নভেম্বর সাফাই সাক্ষ্য শেষে ২৩ নভেম্বর রায়ের দিন ধার্য করেছিলেন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
আসামিদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে লড়েন সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ মোস্তফা, আবুল কালাম আজাদ ও আবু সিদ্দিক ওসমানী। পূর্ব নির্ধারিত সময় হিসেবে আলোচিত এ মামলার রায়ের দিকেই তাকিয়ে ছিল পুরো দেশ।
এদিকে, রায়ের তারিখ ঘোষণা হবার পর থেকে গা-ঢাকা দেন সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাইসহ আত্মস্বীকৃত ৮৪ ইয়াবাকারবারি। এরমধ্যে অনেকেই বিদেশে চলে যাওয়ার গুঞ্জন রয়েছে। ১৫ নভেম্বর সাফাই সাক্ষ্য ও যুক্তি-তর্কের পর ২৩ নভেম্বর (বুধবার) মাদক ও অস্ত্রের দুটি মামলার রায়ের দিন ধার্য করে আদালত। একইদিন আদালতে অনুপস্থিত ৮৪ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আদালতের আদেশের পর আত্মগোপনে চলে যাওয়াদের মধ্যে সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদির চারভাইসহ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও পৌরসভার কাউন্সিলরও রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে। তবে, এজাহার ও চার্জশীটের দুর্বলতা কারণে সাজার পরিমাণ কম হয়েছে বলে ধারণা। আগে সাজা ভোগের বিষয়টি কি হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে, আইনি বিধানে এটি গণ্য হবার কথা।
আসামি পক্ষে আইনজীবী সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, দুটি মামলাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও সমাজে একটি বাজে বার্তা প্রচার হবার ভয়ে আত্মসমর্পণ কৃত আসামিদের প্রতীকী সাজা দিয়েছেন আদালত।
এদিকে, রায়ের তারিখ ঘোষণার পর হতে পলাতক থাকা ইয়াবা কারবারিদের একটি চক্র রায় পক্ষে নিতে বিচারককে কনভিজ করার কথা বলে জনপ্রতি কয়েক লাখ টাকা করে প্রায় তিন কোটি টাকা তুলেছেন, এমন আলোচনা চলছে টেকনাফ জুড়ে। অভিযোগ উঠেছে, সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই আত্মস্বীকৃত ইয়াবা মাফিয়া আবদুর শুক্কুরের নেতৃত্ব চক্রটি এসব টাকা তুলেছেন। আর টাকা জমা রেখেছেন বদির আরেক ভাই আত্মস্বীকৃত ইয়াবা মাফিয়া আবদুল আমিন। রায়ের তারিখ ঘোষণার পর আত্মস্বীকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গোপনে দফায় দফায় বৈঠক করেন আবদুর শুক্কুর। এক পর্যায়ে রায় পক্ষে নেওয়ার কথা বলে জনপ্রতি ৩ লাখ টাকা করে তুলে ফান্ড করার সিদ্ধান্ত হয়। ক্যাশিয়ার নিযুক্ত হন আবদু শুক্কুরের বড় ভাই আত্মস্বীকৃত ইয়াবা মাফিয়া আব্দুল আমিন।
এসব তথ্যের সরাসরি কোন বক্তব্য তারা না দিলেও এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের নিচে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাবেক সাংসদ বদি একটি অশালীন শব্দ ব্যবহার করে লিখেছেন, টাকার জন্য সাংবাদিকরা মিথ্যে নিউজ করে নিরপরাধদের অপরাধী বানাতে চাইছে।
আত্মসমর্পণের পর হওয়া মামলার প্রধান আসামী সাবেক সাংসদ বদির ভাই আত্মগোপনে থাকা আবদুর শুক্কুর তার ফেসবুক একাউন্টে লিখেন, আলহামদুলিল্লাহ- আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হালিম বলেন, আত্মস্বীকৃত ইয়াবাকারবারি যারা জামিন বাতিলের পর পালিয়ে আছে তাদের ধরতে কাজ করছে পুলিশ। আত্মগোপনে গেলেও শেষ রক্ষা হবে না তাদের।
আদালত সূত্র মতে, ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা, ৩০টি দেশীয় তৈরি বন্দুক ও ৭০ রাউন্ড গুলিসহ আত্মসমর্পণ করেন ১০২ জন ইয়াবা কারবারি। টেকনাফ থানার তৎকালীন পরিদর্শক (অপারেশন) শরীফ ইবনে আলম বাদী হয়ে মাদক ও অস্ত্র আইনে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক ২টি মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পান পরিদর্শক (তদন্ত) এবিএমএস দোহা। ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট মোহাম্মদ রাসেল নামে এক আসামি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক তামান্না ফারাহর আদালতে ১০১ আসামির বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে মামলাটি বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল সব আসামির উপস্থিতিতে শুনানি শেষে মামলার চার্জ গঠন করেন। গত ১৪ নভেম্বর সাক্ষীর জেরা ও ১৫ নভেম্বর সাফাই সাক্ষ্য শেষে সেদিন সকল আসামির জামিন বাতিল করে ২৩ নভেম্বর রায়ের দিন ধার্য করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল।
অভিযোগ আছে, কারাগারে বসে ও জামিনে এসে অনেকে ফের ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে গেছে। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় এলাকার অনেককে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে।