- কাদির কল্লোল
- বিবিসি বাংলা, ঢাকা
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনার ৪১ বছর পরও সেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে।
যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, ঘটনার দু’দিনের মধ্যেই তাদের দমন করা হয়েছিল ।
কিন্তু রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে, সেখান থেকে ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িতরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল কিনা-ঘটনার পরে তাদের কর্মকাণ্ডে এ ধরনের বড় কোন পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।
তারা আসলে কী চেয়েছিল, সেটাই এখনও বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানকে ১৯৮১ সালে ৩০শে মে ভোররাতে একদল সেনা সদস্য হত্যা করে।
ঘটনার আগের দিন তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বিরোধ মেটাতে।
সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব
হত্যাকাণ্ডের পর ৩০ শে মে সকালে সেই ঘটনায় জড়িতদের নির্দেশে ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে যেতে হয়েছিল সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর রেজাউল করিম রেজাকে।
তিনি সকালেই সার্কিট হাউজ থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে দেখেছিলেন যুদ্ধের পরিবেশ।
তখন মেজর রেজাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা হয়েছিল।
জেনারেল মঞ্জুর গ্রেপ্তার হওয়ার সময় পর্যন্ত তার সাথে ঐ দায়িত্বে ছিলেন মেজর রেজা।
তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমানকে হত্যা এবং হত্যাকাণ্ডের পরে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা-এমন পরিকল্পনার কোন ইঙ্গিত চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ছিল না।
হত্যাকাণ্ড এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তার পরের ঘটনা প্রবাহ কোন পরিকল্পনা ছাড়াই এবং নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলেছে বলে মেজর রেজার মনে হয়েছে।
তবে তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমান অমুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তাদের বেশি সুযোগ সুবিধা বা পদ-পদন্নোতি দিয়েছেন এবং পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে সেনা প্রধান করেছিলেন।
একারণে জেনারেল মঞ্জুর এবং কর্ণেল মতিউর রহমানসহ মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। এই ক্ষোভের বিষয়টা হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা পরবর্তী ঘটনাবলীতে প্রকাশ করেছিলেন বলে মেজর রেজা উল্লেখ করেন।
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড এবং ঘটনার ব্যাপারে সামরিক আদালতের বিচার নিয়ে গবেষণা করেছেন আনোয়ার কবির।
তিনি জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান-প্রত্যাগত এবং মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভের বিষয়টি হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে বড় কারণ ছিল। এমন তথ্য তিনি তার গবেষণায় পেয়েছেন।
‘জিয়াকে বন্দি করে চাপ সৃষ্টি’
জিয়াউর রহমানকে সার্কিট হাউজ থেকে বন্দি করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে এনে দাবি আদায়ে চাপ সৃষ্টি করা হবে-এ রকম একটি পরিকল্পনার বিষয়ে ঐ সেনানিবাসের কিছু কর্মকর্তা জানতেন।
হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সামরিক আদালতে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা এবং সাক্ষীদের কাছ থেকে এমন তথ্য পেয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম।
সামরিক আদালতে অভিযুক্তদের আত্নপক্ষ সমর্থনের জন্য ডিফেন্ডিং অফিসার হিসাবে জেনারেল ইব্রাহিম সহ তিনজন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল।
তিনি সে সময় সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদবীর অফিসার ছিলেন।
মেজর রেজাউল করিম রেজা জানিয়েছেন, কর্ণেল মতিউর রহমানের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের যে কর্মকর্তা বা সদস্যরা ৩০শে মে ভোররাতে সেখানে সার্কিট হাউজে গিয়েছিলেন, তাদের গভীর রাতে কালুরঘাট ব্রিজের কাছে একটি পাহাড়ে নিয়ে জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে এনে চাপ সৃষ্টির ব্যাপারেই ব্রিফ করা হয়েছিল।
কর্ণেল মতিউর রহমান এই ব্রিফিং দিয়েছিলেন।
সেই ব্রিফিং থেকে সার্কিট হাউজে যারা গিয়েছিলেন, তাদের অনেকের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন মেজর রেজা।
বিদ্রোহী অফিসাররা যা চেয়েছিলেন
সেনা প্রধানের পদ থেকে জেনারেল এরশাদকে অপসারণ করে জেনারেল মঞ্জুর বা অন্য কোন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ঐ পদে নিয়োগ দেয়া হোক- এরকমটাই চেয়েছিলেন বিদ্রোহে জড়িত সেনা কর্মকর্তারা। তাদের অনেকের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছিলেন মেজর রেজা।
একইসাথে পাকিস্তান প্রত্যাগত বা অমুক্তিযোদ্ধা আরও যে কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদে ছিলেন, তাদের সরিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের সে সব পদে নিয়ে আসার দাবিও জানাচ্ছিলেন তারা।
মূলত এই দুটিই ছিল তাদের মূল দাবি।
জেনারেল ইব্রাহিমও সামরিক আদালতে অভিযুক্তদের কাছ থেকে একই ধরনের তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
মেজর রেজা অবশ্য বলেছেন, জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় পাকিস্তানপন্থী মন্ত্রীদের সরানোরও দাবিও ছিল।
হত্যাকাণ্ড ঘটলো কীভাবে
ঘটনায় জড়িতদের কাছ থেকে মেজর রেজা যা শুনেছিলেন, তা হচ্ছে, কর্ণেল মতিউর রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মেহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে সেনা কর্মকর্তা এবং সদস্যদের একটি দল ৩০শে মে ভোররাতে যখন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের কাছে যায়, তখন আকস্মিকভাবে এই দল সার্কিট হাউজের দিকে রকেট নিক্ষেপ করে।
এই পরিস্থিতিতে সেখানে জিয়াউর রহমানের নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের সাথে গোলাগুলি শুরু হয়।
কিন্তু আক্রমণকারী সেনাসদস্যরা সার্কিট হাউজে দোতলায় চলে যায় এবং একপর্যায়ে জিয়াউর রহমান তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন।
সে মুহুর্তেই কর্ণেল মতিউর রহমান খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে জিয়াউর রহমানকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেন।
হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেনাবাহিনীর সাবেক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার লেখা বইয়েও এ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়।
কর্ণেল মতিউর রহমান সে সময় সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ডিভিশনাল হেড কোয়াটার্সের সিনিয়র অফিসার ছিলেন।
আর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মেহবুবুর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে ২১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার।
জেনারেল মঞ্জুরের ভূমিকা কী ছিল
তার ভূমিকা সম্পর্কে নানা রকম বক্তব্য পাওয়া যায়।
মেজর রেজাউল করিম রেজার ধারণা, জেনারেল মঞ্জুর জিয়াউর রহমানকে হত্যার বিষয়টি আগে জানতেন না এবং ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তা জেনেছেন।
মেজর রেজা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের পর ৩০শে মে সকালে তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে সার্কিট হাউজে যে পাঠানো হয়েছিল, তখন সেখানে গিয়ে দুই তলায় সিঁড়ির কাছে বারান্দায় জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ দেখেছিলেন।
এছাড়া দু’জন সেনা কর্মকর্তার মৃতদেহও দেখেছিলেন।
সার্কিট হাউজ থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফেরার পর মেজর রেজার কাছে সার্কিট হাউজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মৃতদেহ পড়ে থাকার বর্ণনা দিয়েছিলেন।
তখন জেনারেল মঞ্জুর তাকে বার বার বলেছিলেন, “ওহ হোয়াট হ্যাভ দে ডান”- “ওরা কী করেছে”?
তবে জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন মেজর রেজা।
তিনি বলেন, তিনি প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব পাওয়ায় ৩০শে মে সকাল থেকে সারাক্ষণ তাকে জেনারেল মঞ্জুরের সাথে থাকতে হয়েছেন।
সকাল থেকেই জেনারেল মঞ্জুর সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য সেনা কর্মকর্তা এবং সৈনিকদের বিভিন্ন ব্যারাকে ঘুরে ঘুরে বক্তব্য দিয়েছেন।
তবে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জেনারেল মঞ্জুর জানতেন না-এটা মানতে রাজি নন জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম।
ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে জেনারেল ইব্রাহিম মনে করেন, জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রামে জিওসির দায়িত্বে থাকার সময় আগেও জিয়াউর রহমানকে হত্যার একাধিকবার ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল।
ফলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জেনারেল মঞ্জুরের অগোচরে ঘটেনি বলে উল্লেখ করেন জেনারেল ইব্রাহিম।
তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের মধ্যে কর্ণেল মতিউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে বীরবিক্রম খেতাব পা্ওয়া এবং লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মেহবুবুর রহমান ছিলেন বীর উত্তম খেতাবধারী। আর মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য জেনারেল মঞ্জুরও বীরউত্তম খেতাব পেয়েছিলেন।
“মতিউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুরের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। এছাড়া মেহবুবুর রহমান সম্পর্কে জেনারেল মঞ্জুরের ভাগ্নে ছিলেন” উল্লেখ করেন জেনারেল ইব্রাহিম।
বিপ্লবী পরিষদের ঘোষণা
গবেষক আনোয়ার কবির জানিয়েছেন, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর ৩০শে মে জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম বেতার থেকে কয়েকবার ভাষণ দিয়েছিলেন।
সেই ভাষণে জেনারেল মঞ্জুর জেনারেল এরশাদকে সেনা প্রধানের পদ থেকে বরখাস্ত এবং জেনারেল মীর শওকত আলীকে সেনা প্রধান হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এছাড়া বিপ্লবী পরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে জেনারেল মঞ্জুর সেনা বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন বলে আনোয়ার কবির উল্লেখ করেন।
তিনি মনে করেন, জেনারেল মঞ্জুর হয়তো ভেবেছিলেন তাদের সমর্থনে ঢাকা সেনানিবাসে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে সাড়া দিতে পারে। কিন্তু তা হয়নি।
মেজর রেজাউল করিম রেজার বক্তব্য হচ্ছে, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল বা কোন নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব নয়-এই বিবেচনা তখন জেনারেল মঞ্জুর বা অন্যদের কাজ করেনি বলে তার মনে হয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, সে সময় চট্টগ্রামে জেনারেল মঞ্জুর সহ অন্যরা সিদ্ধান্ত নিতে অস্থিরতায় ভুগেছেন এবং পরিকল্পনা ছাড়া ঘটনাপ্রবাহ তার মতো করে এগিয়ে গেছে।
হত্যাকাণ্ডের পেছনে
যদিও এ ঘটনায় মূলত জেনারেল এরশাদকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ এবং মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগতদের নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টিই সামনে এসেছে, কিন্তু ঘটনার পেছনে জেনারেল এরশাদের কোন ভূমিকা ছিল কীনা-এই প্রশ্নও অনেকে তুলেছেন।
মেজর রেজা বলেছেন, তিনি নিজে দেখেছেন যে, ৩০শে মে ঢাকা সেনানিবাস থেকে জেনারেল এরশাদ জেনারেল মঞ্জুরকে পর পর দু’বার টেলিফোন করেছিলেন কথা বলার জন্য। কিন্তু জেনারেল মঞ্জুর কথা বলেননি।
সেই টেলিফোনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মেজর রেজা বলেন, “ঢাকা সেনানিবাস থেকে আসা টেলিফোনে জেনারেল মঞ্জুরকে বলা হয়, ফর গডস সেইক স্যার, ফর গডস সেইক-ইউ টক টু জেনারেল এরশাদ। তখন জেনারেল মঞ্জুর বলেন, আই ক্যান্ট টক উইথ এরশাদ, এই কথা বলে জেনারেল মঞ্জুর টেলিফোন রেখে দিয়েছিলেন।”
তবে জেনারেল এরশাদের সাথে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অন্য কারও সম্পর্ক ছিল কিনা এবং মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্বের সুযোগ সেখানে নেয়া হয়েছে কীনা- এই সন্দেহ রয়েছে মেজর রেজার।
তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমানকে হত্যার কয়েকদিন আগে কর্ণেল মতিউর রহমান ঢাকা সেনানিবাসে গিয়ে জেনারেল এরশাদের সাথে কথা বলেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনার অনেক পরে তিনি এ কথা শুনেছিলেন।
জেনারেল ইব্রাহিম জানিয়েছেন, কর্ণেল মতিউর রহমান এবং মেহবুবুর রহমানের সাথে জেনারেল এরশাদের হত্যাকাণ্ডের অনেক আগে থেকে সম্পর্ক ছিল, এমন তথ্য তিনি পেয়েছিলেন।
জেনারেল এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থায় জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলায় আদালতে শুনানিতে এ ধরনের অভিযোগ এসেছিল। কিন্তু শুনানিতে জেনারেল এরশাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছিল বলে তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
বিএনপি ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করে যেভাবে
দলটির নেতারা মনে করেন, জিয়াউর রহমানকে হত্যার পেছনে বড় পরিকল্পনা ছিল।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাই এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বলে তারা বিশ্বাস করেন।
তারা অনেক সময় এর পেছনে রাজনৈতিক এবং বিদেশী ষড়যন্ত্র থাকার অভিযোগও করে থাকেন।
জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং পরে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
কিন্তু দশ মাস পর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন।
এই পটভূমিকে বিএনপি নেতারা তাদের বক্তব্যে যুক্তি হিসাবে তুলে ধরেন।
বিচারপতি সাত্তার সরকারের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল অলি আহমেদ।
তিনি পরে ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি ২০০৬ সালে বিএনপি ছেড়ে এলডিপি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন।
কর্ণেল অলি আহমেদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সামরিক সচিব ছিলেন।
তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িতদের ধরার সাথে সাথেই হত্যা করা হয়েছিল।
সে সময় সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছিল যে, চট্টগ্রাম সেনানিবাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে কর্ণেল মতিউর রহমান এবং লেফটেন্যান্ট মেহবুবুর রহমান নিহত হয়েছিলেন।
তখন সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, তারা গোলাগুলিতে নিহত হন।
এছাড়া ৩১ শে মে জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর একটি চা বাগান এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু আটকের পর তাকে হত্যা করা হয়।
এই ঘটনাগুলো তুলে ধরে অলি আহমেদ বলেন, ঘটনার পরিকল্পনাকারি বা পেছনের কারও বিষয় যাতে প্রকাশ না পায়, সেজন্য হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের হত্যা করা হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন।
অলি আহমেদ বলেন, “এসব ঘটনা এবং জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে জিয়া হত্যার পূর্বপরিকল্পনার প্রমাণ মেলে।”
মঞ্জুর হত্যা মামলায় জেনারেল এরশাদ ছিলেন প্রধান অভিযুক্ত।
কিন্তু চার দশক পার হলেও সেই মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। এরমধ্যে জেনারেল এরশাদের মৃত্যু হয়েছে।
২০১৬ সালে মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বিএনপি নেতা এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ বিবিসিকে বলেছিলেন, জিয়াউর রহমানকে হত্যার বছর দুয়েক আগে থেকে সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল এর জেরেই পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
রহস্য উন্মোচন হয়নি কেন
জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনার বিচার না হওয়ায় এর উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম যিনি সামরিক আদালতে অভিযুক্তদের জন্য সেনাবাহিনী তরফ থেকে ডিফেন্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
তিনি জানিয়েছেন, সামরিক আদালতে শুধু বিদ্রোহের বিচার হয়েছিল।
সেই বিচারে ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১২জনই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
তবে জিয়াউর রহমানের পরিবার বা বিএনপির পক্ষ থেকে কখনও হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি বা মামলা করা হয়নি।
এ প্রশ্নে বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন সময় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল অলি আহমেদ এই বিচার না করার বিষয়কে দু:খজনক বলে মনে করেন।
মূল- https://www.bbc.com/bengali/news-61627056