সপ্তাহখানেক আগে কপ-২৭ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশ অংশ নেয়। জাতিসংঘের এই বৃহৎ জলবায়ু সম্মেলনে উপস্থিত দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জাপান। বিশ্বব্যাপী জ্বালানিসংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন যে হারে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে টোকিও। এ নিয়ে দেশগুলোর কূটনৈতিক তত্পরতা বৃদ্ধিরও দাবি জানায় দেশটি। একই সঙ্গে এ থেকে কীভাবে মুক্তি লাভ করা সম্ভব, সে সম্পর্কেও রূপরেখা তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে, এ দুটি ক্ষেত্রে জাপান কী ধরনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, তা তুলে ধরে দেশটি। জাপানের দাবি, দেশের ন্যাচারাল রিসোর্স কোম্পানি ‘জাপান অরগানাইজেশন ফর মেটালস অ্যান্ড এনার্জি সিকিউরিটি’কে ঢেলে সাজাচ্ছে টোকিও। এমনকি এই কোম্পানির তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনি প্রকল্পে স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জাপান সরকার।
জাপানের এই উদ্যোগকে খালি চোখে নিছক ক্ষুদ্র বিষয় বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এটি শুধুই ‘নাম পরিবর্তন’ করার ঘটনায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ পদচারণা, যা সারা বিশ্বের জন্য, বিশেষ করে এশিয়াব্যাপী অনুকরণীয় হতে পারে। এর কারণ, বর্তমান বিশ্বে জ্বালানি নিরাপত্তাই হয়ে উঠেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
আমরা জানি, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রশ্নে বিশ্বের নীতিনির্ধারকেরা বহুদিন ধরে একটি ‘ট্রাইলেমা (কোনো কঠিন সমস্যার তিনটি সম্ভাব্য সমাধানের একটিকে বেছে নিতে পারা। একে ‘কঠিন ত্রিত্ব’ও বলা হয়)’ নিয়ে ঠেলাপাড়া করে চলেছেন। বিশ্বনেতৃত্ব সমাধানে আসতে পারছেন যে, কীভাবে টেকসই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, মূল্য সহনীয় রাখা যায় এবং একই সঙ্গে পরিবেশও রক্ষা করা যায়। অপরিশোধিত তেল থেকে শুরু করে গম কিংবা অ্যালুমিনিয়ামের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলো বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। এ ধরনের ট্রাইলেমা আসলেই বেশ ভোগান্তিতে ফেলে দেয়; ঠিক বুঝে ওঠা যায় না যে, কোন পথে হাঁটলে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই সুবিধা মিলবে।
১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে প্রথম ও দ্বিতীয় তেলসংকট আমাদের স্মৃতিতে আজও গেঁথে আছে। সেই সংকটকালে জ্বালানি নিরাপত্তা ও ক্রয়ক্ষমতা বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। জ্বালানি সরবরাহ এতটাই বাধার মুখে পড়ে যায় যে, টাকা থাকা সত্ত্বেও তেল পাওয়া যাচ্ছিল না! এমন পরিস্থিতিতে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জি৭ শীর্ষ সম্মেলনে জ্বালানি ব্যয় কমাতে ‘যত দূর সম্ভব কয়লার ব্যবহার বাড়াতে’ একমত হয় দেশগুলো। আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের উত্থানের সঙ্গে তাল মেলাতে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে এই চিন্তা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় দেশগুলো। বিশেষত, বিগত দশক থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা লাগামহীন হয়ে ওঠার কারণে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে প্রতিশ্রুত হয় দেশগুলো।
আজকের বিশ্বেও জ্বালানিসংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এর ফলে সরকারগুলো ‘করণীয় ও অগ্রাধিকার’ ঢেলে সাজাতে বাধ্য হচ্ছে স্বভাবতই। কোনো সন্দেহ নেই, আগের মতোই জ্বালানি সরবরাহ ও ক্রয়ক্ষমতার প্রশ্নে সত্তর-আশির দশকের চিত্র ফিরে এসেছে! দেশগুলোর হাতে অর্থ থাকলেও কার্যত জ্বালানি পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাত্, আগের চিত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে। সত্যি বলতে, নীতিনির্ধারকেরা জোর দিয়ে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পিছপা হব না আমরা।’ কিন্তু এটা স্পষ্ট, জ্বালানি নিরাপত্তা ও জলবায়ু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে! দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে দেশগুলো আছে বড় প্রশ্নের সামনে—জ্বালানি, নাকি জলবায়ু?
এই যখন অবস্থা, তখন দেশগুলোর লক্ষ্য একটাই—কার্বন নিঃসারণকে সহনশীল মাত্রায় রাখার পাশাপাশি টেকসই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য এমন কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে উভয় ক্ষেত্রেই সুফল পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে জ্বালানি সুরক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, আমরা বহুকাল ধরে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপরই নির্ভর করে আছি।
কপ-২৭ সম্মেলনে বরাবরের মতোই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে, গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে আমরা খুব একটা অগ্রগতি করতে পারিনি আজও। এর বড় উদহারণ, জীবাশ্ম জ্বালানির অতিব্যবহারের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া। পরিতাপের বিষয়, ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি ছিল—বিরূপ জলবায়ুর শিকার দরিদ্র দেশগুলোকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করা হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দৃষ্টান্ত দেখেছি।
উল্লেখ করার মতো বিষয়, জ্বালানিসংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, তা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইকে লাইনচ্যুত করবে না বলে কথা দিয়েছে দেশগুলো। কিন্তু শংসয় থেকেই যায়, বিভিন্ন দেশ অতীতে যেভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কী?
বর্তমানে জ্বালানিসংকটে ভুগছে গোটা বিশ্ব। ধনী-দরিদ্র প্রতিটি দেশের অবস্থাই বেশ করুণ। এমনকি ‘দ্য অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)’ ক্লাবের অন্তর্ভুক্ত ধনী দেশগুলোও রয়েছে চরম ভোগান্তিতে। চলতি বছর মোট দেশজ উত্পাদনের ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ জ্বালানি খাতে ব্যয় করতে বাধ্য হয় ওইসিডিভুক্ত দেশগুলো। ওইসিডির হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানি খাতের এই বিপুল খরচ ইতিহাসে এমন এক রেকর্ড, যা ১৯৮০-১৯৮১ সালের দ্বিতীয় তেলসংকটের সময়কার ১৭ দশমিক ৮ শতাংশের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়।
তবে মনে রাখতে হবে, সমস্যাকেই শুধু বড় করে দেখলে চলবে না। এর সমাধানের রাস্তা নিয়েও ভাবতে হবে। সঠিক রাস্তা ধরে এগোলে এবারের সমস্যা থেকেও মুক্তি মিলবে। ১৯৭৯ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত জি৭ শীর্ষ সম্মেলনের নীতিনির্ধারকেরা জ্বালানি সমস্যার সমাধানে কয়লার দিকে ঝুঁকেছিলেন। চার দশক পর আজও ঠিক একই ধরনের সমস্যার সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্ব। সুতরাং, এবার ভুল শোধরানোর সুযোগ। ভেবেচিন্তে সমাধান বের করতে হবে, যাতে এই গ্রহকে রক্ষা করার স্বার্থে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির অগ্রগতি ঘটিয়ে যুগান্তকারী মাইলফলক তৈরি করা যায়।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এ বছর ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু করলে প্রতিটি দেশ জ্বালানির গুরুত্ব উপলব্ধি করে হাড়ে হাড়ে। পুতিন যখন ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করার ঘোষণা দেন, তখন থেকেই ইউরোপের দেশগুলোর বুকে কাঁপুনি ধরে যায়। এরপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জবাব দিতে রাশিয়া গ্যাস সরবরাহকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করলে চরম অচলাবস্থা তৈরি হয় সারা বিশ্বে। অবস্থা দিনে দিনে এতটাই কঠিনতর হয়ে উঠছে যে, বৈশ্বিক মহামন্দার আশঙ্কাসহ ইউরোপের জন্য আজ বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে ‘শীতকাল’।
এমতাবস্থায়, সহজ হিসাব—জীবাশ্ম জ্বালানি কোনোভাবেই নিরাপদ ও নিশ্চিত জ্বালানি নয়। অর্থাত্, আাামাদের জন্য এখন সমাধানের পথ হলো ‘গ্রিন এনার্জি’। তাই এ বিষয়ে আমাদের অতিসত্বর কাজ শুরু করতে হবে। বিশেষ করে, জি৭কে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। বায়ু ও সৌরশক্তি নিয়ে কাজ করতে হবে। গ্রিন এনার্জি নিয়ে গবেষণা বাড়াতে ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে ভাবতে হবে। এসবের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়নের জন্য সরকারগুলোকে চাপ দিতে হবে। ‘একটি ঘর, একটি সৌর প্যানেল’—এই স্লোগানকে সর্বময় করে তুলতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই, সোলার সিস্টেমই সমস্যার উত্তরণ ঘটাতে পারে। এর হাত ধরেই নিশ্চিত হতে পারে জ্বালানি নিরাপত্তা। পাশাপাশি জ্বালানি ব্যবহারেও হতে হবে মিতব্যয়ী। জ্বালানিসংকট সমাধানের সর্বোত্তম উপায় মূলত এর সঠিক ও পরিমিত ব্যবহারে মনোনিবেশ করা।
কথা বলা যতটা সহজ, তার সঠিক বাস্তবায়ন ততটা সহজ নয়—এ কথা সবারই জানা। কিন্তু যে কোনো মূল্যে আমাদের সফল হতেই হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা বিশ্বে এতটাই বেড়ে গেছে যে, এখান থেকে ফিরতে পারাটা সহজ হবে না। বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে—তেল, গ্যাস ও কয়লা কিনতে দেশগুলো যে অর্থ ব্যয় করে, তা এক কথায় ‘বিপুল পরিমাণ’। অর্থাৎ, বলা যায়, পৃথিবী ভুল পথে হাঁটছে।