জুয়েল সাদত
ওরলান্ডো, ফ্লোরিডা।
প্রথমে ভেবেছিলাম কাগজের বউ বা কাগজের স্বামী এরকম একটা ইন্ট্রো দিয়ে শুরু করব, কিন্তু পরে দেখলাম বিষয়টা এতো সহযে বর্ণনা করা যায় না, এর সাথে অনেক বড় আকারে সামাজিক, মানসিক ও আর্থিক ফ্যাক্টর যুক্ত। এতো বড় বড় ফ্যাক্টর বর্তমানে বিয়েটাকেই কাগজে বন্দি করে নিয়েছে। আমেরিকায় থাকা বাংলাদেশীদের কাছে কাগজের বিয়ে কনট্রাক্ট ম্যারেজ নামে পরিচিত, তারা বিষয়টা এ ভাবেই জানে ও শুনে অভ্যস্ত।
৮০-র দশকে নানা দেশ থেকে বাংলাদেশীরা আমেরিকায় এসে মূলত দুটো মাধ্যমে লিগ্যাল হন। একটা ফার্মার হিসাবে আর একটি কন্টাক্ট ম্যারেজ করে। কন্টাক্ট ম্যারেজটা ছিল কোন আমেরিকান বা অন্য যে কোন দেশের আমেরিকান সিটিজেন মেয়েকে টাকার বিনিময়ে চুক্তিতে বিয়ে করে লিগ্যাল হওয়া। সেটায় আবার কেউ একসাথে থাকতেন আবার কেউ থাকতেন না। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে সেই মেয়েটির স্পাউজ হিসাবে আমেরিকার রেসিডেন্সিটা পেয়ে যাওয়া, এটাই ছিল কন্টাক্ট ম্যারেজ। সেক্ষেত্রে ঐ মেয়েটাকে গাড়ী বা এককালিন টাকা পরিশোধ করতে হত।
এই মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশী না আমেরিকার অভ্যন্তরে লাখ লাখ ইলিগ্যাল মানুষরা লিগ্যাল হয়েছিলেন। কাগজহীন প্রবাসী আমেরিকার কাগজ করেছেন। যতটা সহজে বলছি বিসয়টা এত সহজ ছিলো না। অনেক কঠিন ছিল এবং এখনও আছে। অনেক সময় কন্টাক্ট ম্যারেজ করে অনেকেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চেয়ে মুসলিম হিসাবে কনভার্ট করেছিলেন ঐ মেয়েটাকে, বাচ্চাও নিয়েছিলেন। তারপর কাগজ হয়েছে সংসার হয়নি। আবার অনেক সময় দেখা যায় মেয়েটা ড্রাগ এডিক্টেটড, নেশার টাকা যোগাতে এ পথ বেছে নেয়। এদেরকে সহজেই পাওয়া যেত, তাদের জীবন-যাপন ছিলো নিয়ন্ত্রনহীন, অনেক সময়ই এরা জেলে যায় আর সেটা যদি হয় পার্টনারের লিগাল কাগজ পাওয়ার আগে সেটা তার পার্টনারের জীবন বিষিয়ে তোলে কারন তাকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে নিজেরই জন্যে।
হয়তো এভাবে একদিন সে বৈধতা পায় কিন্তু এর জন্য চুকাতে হয় বড় মাপের মূল্য। এর পরে হয়তো দু’জন দুই দিকে চলে যায়। অনেকেই এর পরে দেশে গিয়ে আবার বিয়ে করে স্ত্রীকে এ দেশে নিয়ে এসেছেন। তাদের অনেকে আজ ভালো আছেন সুখে আছেন। অনেকেই এই পথে লিগ্যাল হয়ে আজ এখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
(দুই)
ইংল্যান্ডে কন্টাক্ট ম্যারেজ করে লিগ্যাল হবার শতকরা হিসেব ১ শতাংশ এর অনেক নীচে। যারাই লিগ্যাল হয়েছেন লন্ডনে বিয়ে করে বা রেস্টুরেন্ট এর নানা সিস্টেম এ। ইদানিং আমেরিকা ও ইংল্যান্ড স্টুডেন্ট ভিসা আইন সহজ করেছে। এটা আর একটা কৌশল, কলেজ ও ইউনিভারসিটি আছে অর্থ সংকটে। আমেরিকায় যদিও স্পাউস নিয়ে আসার সুযোগ কম, একমাত্র হায়ার ক্লাসের গবেষনা বা পিএইচডি করতে আসলে স্পাউজ নিয়ে আসা যায়।
ইংল্যান্ডে একজন বিবাহিত ছেলে তার স্ত্রী সন্তান ও একজন বিবাহিত মেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে আসতে পারেন। যারা লন্ডনে আসছেন তারা রিয়েল স্টুডেন্ট বা কম বয়েসী তারা এই সিস্টেমটার অপব্যবহার করছেন। এখন মেয়েরা কন্টাক্ট এ ভুয়া স্বামী নিয়ে এম্বেসীতে যাচ্ছেন অপরদিকে ছেলেরা কন্টাক্ট এ ভুয়া বউ নিয়ে এম্বাসীতে উঠছেন। সিলেটে এই বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। এই অনৈতিক কাজটা লোভী পিতা-মাতারা দ্বিধাহীন ভাবে করে যাচ্ছেন। ইংল্যান্ড অবস্থানরত কারও পরামর্শ না নিয়ে কাজটা করছেন। ভিসাটা সহজ করেছে কারন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলো এখন অর্থ সংকটে।
সিলেট থেকে আপনি আপনার মেয়েকে লন্ডন পড়তে পাঠাচ্ছেন। আরেকটি অপরিচিত পরিবারের ছেলের সাথে চুক্তি করে সাজানো স্বামী বানিয়ে কিছু টাকা নিচ্ছেন, মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করাবেন। আর এর জন্য একটি ভুয়া কাবিন ও বিয়ের ছবি তোলা হচ্ছে।
এরকম একটি অনৈতিক কাজে দুই পরিবারের লোভ কাজ করে। লন্ডন পৌছে দুজন দু’ঠিকানায় যাবেন। লন্ডনে আন্ডার গ্রাজুয়েট পড়তে বছরে ১১ হাজার পাউন্ড লাগবে। থাকতে ও আনুষঙ্গিক আরো ৫/৬ হাজার পাউন্ড।
বাংলাদেশ থেকে এ টাকা কি আপনি দিতে পারবেন? পারবেন না। কারন আপনি এমনিতেই ৭/৮ লাখ খরচ করে ফেলেছেন ধার করে। ছেলেরা হয়ত ফুড ডেলিভারি দিয়ে কিছু পাউন্ড ম্যানেজ করতে পারবে। তবে কলেজের টিউশন ফি দিতে পারবে না। পড়াশুনা হবে না।
যতই ঘনিষ্ঠজন থাকুক কেউ ৩০ দিনের বেশী বাসায় রাখবে না। রাখার মত তাদের আসলে জায়গা নাই। ২ বেডের ১ বাথরুমের বাসা। চাইলেও পারছে না। আপনি সেটা সিলেট থেকে বুজতে পারবেন না। আপনি আপনার মেয়েকে এই কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলবেন না। এই ঘটনা লন্ডনে ৮৫ শতাংশ স্টুডেন্টদের।
যা সহজে পাওয়া যায় তাতে সমস্যা থাকে। কাগজের বিয়ে নামের এই অনৈতিক কাজে আপনি লোভে জড়াচ্ছেন কেন? বাংলাদেশের ইউনিভারসিটিতে পড়ে অনেকেই ভাল করছে। আপনি অভিভাবক আপনি কোন নেশায় আপনার কোমলমতি সন্তানকে সমুদ্রে ফেলছেন? যে ছেলেটা এক গøাস পানি নিজ হাতে নিয়ে খায়নি সে মাইনাস ১০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় গভীর রাতে বাই সাইকেল চালিয়ে ফুড ডেলিভারি দিয়ে এক পিস পিজা খেয়ে ঘুমিয়ে সকালে উঠে বাবা মাকে বলে ভাল আছে। কলেজে না গিয়ে বলে রীতিমত ক্লাস করে। মেয়েরা কিভাবে আছে সেটা জেনে নিবেন।
(তিন)
এক মালায় তিন বিয়ে। বাংলাদেশের মেয়েরা মেধাবী, তাই তারা খুব সহজে স্টুডেন্ট ভিসা পায়, তাই স্পাউস হিসাবে ছেলেদের লন্ডনে নেয়ার জন্য টাকার বিনিময় এখানেও চুক্তি হচ্ছে। সিলেটের একটি আধুনিক ম্যারেজ সেন্টারের মালিক বলেন এক রাতে তিনটি ফেইক বিয়ে (কাগজের বিয়ে) হচ্ছে। তারা ৫০০০ হাজার নিচ্ছেন। একজন ফটোগ্রাফার, এক জোড়া মালা, এক বাক্স মিষ্টি, একজন কাজী ও ৭/৮ জন করে আত্মীয়-স্বজন। সবই মিলে বিয়ের অভিনয় করেন, ফটোসেশন করেন এর পরে নিজের প্রপ্য নিয়ে যে যার পথে চলে যান। এর পরে শুরু হয় দুই পরিবারের জীবন যুদ্ধ। বেশীর ভাগ ভুয়া বিয়ে হয় রাতে। ম্যারেজ সেন্টারের সেই মালিক জানান অন্য সেন্টারগুলো ৪০ হাজার পর্যন্ত চার্জ করে আর তিনি মাত্র ৫০০০ হাজার নিচ্ছেন।
কাজী সাহেব কাগজপত্র ঠিক করে দেন, এখানে বর-কনের কবুল বলতে হয় না তবে তারা মালা বদল করেন, মিষ্টিমুখ করেন আর এসবের ভিডিও করেন ছবি তোলেন বিয়ের ডকুমেন্ট তৈরির জন্য, হয়তো কেউ কাওকে চেনেনা এর আগে একজন আরেকজনকে কখনো দেখেওনি, তাতে কিছু যায় আসে না ভিসাই মূখ্য। ভুয়া বিয়ের ডকুমেন্ট হাতে আসলে তা নিয়ে তারা এম্বেসীতে ছোটেন, শুরু হয় স্বপ্নভঙ্গের যাত্রা।
নৈতিক ভাবে কতটা নীচে নামলে দুটো পরিবার এ রকম অনৈতিক কাজ করতে পারে, তা ভাবতেই খারাপ লাগে। এ রকম ঘটনা শত শত ঘটছে, নানা সেন্টারে। আগে রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার জন্য জেল গেটে ছবি তুলে ভুয়া মিটিং এর ফটো স্যুট করে ভিসার লাইনে দাড়িয়ে যেত সহজ পথে পরবাসী হওয়ার মিছিলে। আর এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে একদিনে এক মালায় একই কাজীর হাতে একই ক্যামেরা ম্যানে ৪/৫ টি বিয়ের ফটো সেশন বা বিয়ে নাটক অভিনিত হয়। বর্তমানে লন্ডন যাবার এই কাগজের বিয়েটা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।
আমরা চাই অভিভাবকরা এই অনৈতিক কাজটা থেকে সরে আসবেন। সঠিক ছাত্র হিসেবে বিদেশে যাওয়া কঠিন নয়। তবে তা হতে হবে সততায় ও সঠিক মাধ্যমে। যে মেয়েরা লন্ডনে যাচ্ছেন তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সেখানে। ছেলে মেয়েরা লন্ডনে কঠিন অবস্থার মূখে নষ্ট করে সোনালী সময়।