দেশের ডলার সংকটে আমদানি নিয়ন্ত্রণের প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে। শিল্পে বিনিয়োগ স্থবিরতা আরও গভীর হয়েছে। একদিকে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে শিল্পে কাঁচামাল আমদানি। উচ্চমূল্য থাকায় আমদানি কমিয়ে দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ফলে সামনের দিনগুলোতে কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির নতুন এলসি খোলার তথ্যই বলছে, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে দেখেশুনে এগোচ্ছেন। বিনিয়োগের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) পরিমাণ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে গত বছরের তুলনায় ৬৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ কমে ৬০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার হয়েছে। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৯২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। একই ভাবে, শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত মধ্যবর্তী পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা, উভয়ই উল্লিখিত প্রান্তিকে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশের চেয়েও বেশি কমেছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের উচ্চমূল্য এবং মূল্যস্ফীতির মতো বর্তমানের অস্থিতিশীল পরিবেশে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাবে না।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি মানেই নতুন বিনিয়োগ। অর্থনীতির এই অস্থিরতার মধ্যে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। পরিস্থিতি আরও পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি বন্ধ রয়েছে। উচ্চ মূল্য থাকায় আমদানি কমিয়ে দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা আর সরকারও অপ্রয়োজনীয় আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ এনেছে। মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল হলে আগামী বছর ফের আমদানি বাড়তে বাড়তে পারে। এই বছরে খুব একটা পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন না তিনি। জানতে চাইলে বাংলাদেশের নিট পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ কারখানা এক্সটেনশনে যাচ্ছেন না। একদিকে যেমন বিশ্ব মন্দার আশঙ্কা, অন্যদিকে দেশে গ্যাস, বিদ্যুতের চরম সংকট। এত সংকটের মধ্যে উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। এ জন্য নতুন বিনিয়োগে উদ্যোক্তরা আগ্রহী নয় বলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত দেড় বছরে দেশ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। এর প্রধান কারণ পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে অনেক উদ্যোক্তা তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছেন। বর্তমানে রপ্তানিতে খুব বেশি প্রবৃদ্ধি নেই। সে কারণে ব্যবসার প্রসার কমছে। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এতে, অদূর ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দীর্ঘমেয়াদে শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি স্থবির হয়ে যেতে পারে।
টেক্সটাইল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, নতুন কয়েকটি মিল বর্তমান সংকটের আগেই মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ঋণপত্র খুলেছিল। যারা আগে এলসি খোলেননি তারা এখন এলসি খোলার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এ কারণে নতুন সব কারখানা নির্ধারিত সময়ে উৎপাদনে আসতে পারবে না। তিনি উল্লেখ করেন, টেক্সটাইল কারখানায় গ্যাস সরবরাহের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে এবং উৎপাদন ও মেশিন আমদানিতে প্রভাব পড়ছে।
এদিকে বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তারা আগের মতো ঋণ পাচ্ছেন না। সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর আগের মাসে আগস্টে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কোভিড পরবর্তীতে দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল। মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় আমানতের রেট প্রায় ৭ শতাংশের কাছে। অন্যদিকে মানি মার্কেটে রেট হাই, তাই ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে নামমাত্র প্রফিটে ঋণ দিতে। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে আমদানি অনেকটা কমছে। এছাড়া সামনে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়—সেটা চিন্তা করে অনেকে ঋণ নিচ্ছে না। যার ফলে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতির দিকে।