জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিনিয়ত পৃথিবীর চেহারা বদলে যাচ্ছে। সবুজ পৃথিবী আস্তে আস্তে মরুভূমি হচ্ছে, নদীনালা তার গতিপথ হারাচ্ছে, বৃষ্টিপাত কমতে কমতে একদম শূন্যের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে, হাওর-বাঁওড় শুকিয়ে সেখানে গুল্মলতা জন্মাতে শুরু করেছে, পানির স্তর দিনকে দিন নিচে নেমে যাচ্ছে, শিল্পকারখানা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে গিয়ে কার্বনের পরিমাণ বাড়ছে, ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সামুদ্রিক প্রাণী বেশি বেশি মারা যাচ্ছে, প্লাস্টিকের উৎপাদন বাড়ছে, নিম্নভূমি নিমজ্জিত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত আকস্মিক বন্যা ও নদীভাঙন হচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক রূপ ফিরিয়ে দিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই! মুখে মুখে শীর্ষ দেশগুলো পাশে থাকার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে পরিবেশ রক্ষায় তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ! নিজেরা বেশি কার্বন নিঃসারণ করে আবার অন্যদের কমাতে বলে। গত ৬-১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক কপ-২৭ সম্মেলন। ইউএনএফসিসির ১৯৭টি দেশের অংশগ্রহণ এবারের সম্মেলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। এই সম্মেলনে মূল নেগোসিয়েশনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল অ্যাডাপটেশন, মিটিগেশন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ।
সম্মেলনে ধনী দেশগুলোর নেতারা নানাভাবে তাদের মতামত তুলে ধরেন। দেশগুলোর কাছে প্রত্যাশা ছিল একটু বেশিই; যেমন—কার্বন নিঃসারণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে আনা, গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ধরে রাখা এবং পর্যাপ্ত অনুদান বরাদ্দের ক্ষেত্রে অবদান রাখা। কিন্তু প্রত্যাশার কতটা পূরণ হবে তা সময়ই বলে দেবে। তহবিল গঠনের ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসার দাবি জানানো হয়, যা পূরণ করা হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। মূলত ২০৩০ সালের মধ্যে মোট তহবিল প্রয়োজন ২ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু এর বাস্তবতা তেমন একটা চোখে পড়েনি। সুতরাং, শঙ্কাও থেকেই যাচ্ছে।
আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে পৃথিবীর পরিবেশে মোটামুটি ভারসাম্য বজায় ছিল। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ততই হুমকির মুখে পড়ছে! তাই তহবিল গঠনে উন্নত দেশগুলোর গড়িমসি কারো জন্য সুসংবাদ বয়ে আনবে না। সবুজ পৃথিবী ধ্বংস করে এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোও শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে পৃথিবী এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগতভাবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, স্বল্প মেয়াদে দেশগুলো লাভবান হবে বটে, কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি। কালক্রমে সব দেশকেই এর কুফল ভোগ করতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘মানবজাতির সামনে দুটি কঠিন বিকল্প রয়েছে—বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করা কিংবা সম্মিলিত আত্মহত্যা।’ পরিবেশ বিজ্ঞানীরাও বলছেন একই কথা—তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ, কতটা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, তা ভাবলেই শিহরিত হতে হয়! দুঃখজনকভাবে কপ-২৬-এ যে দাবি রাখা হয়েছিল, কপ-২৭-এ তার কিছুই পূরণ করা যায়নি। তবু আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কার্বন নিঃসারণের পরিমাণ কমানো এবং বড় তহবিল গঠনের কোনো বিকল্প নেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গোটা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশের চেহারাও অনেকটা বদলে গেছে। বিগত কয়েক বছরের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে সেটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। বিশ্বব্যাংকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতা আরো বাড়লে দক্ষিণের বরফ গলার হার বাড়বে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে পানির স্তর। তখন সমুদ্র উপকূলের আশপাশে গড়ে ওঠা দেশগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই তালিকায় ওপরের দিকে আছে বাংলাদেশ। আমাদের সামনে বাস্তবিক অর্থেই মহাবিপদ! লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হবে, কাজ হারাবে, রোগব্যাধি বাড়বে, শিশুমৃত্যুর হার বাড়বে এবং সার্বিকভাবে একটা খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। সুতরাং, আমাদের আগেভাগেই চিন্তাভাবনা করতে হবে। সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা দিলেও তার প্রভাব আমাদের ওপর যেন বেশি না পড়ে, সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার পাশাপাশি এখন থেকেই ‘সবুজ বাংলাদেশ’ গড়ার শপথ নিতে হবে। মোটকথা, আসন্ন ক্ষতি লাঘবে নিতে হবে কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা।