খেলার ৮২ মিনিট পার হয়ে গেছে। কোনো গোলের দেখা নেই। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। বক্সের ভেতর বল পেলেন রদ্রিগো। পেছনের পায়ে ফ্লিক করলেন। বল ক্যাসিমিরোর পায়ে। বক্সের বাম কোনা থেকে দুরন্ত এক ভলি। ডান পাশের নেটে জড়িয়ে গেলো বল। শুরু হলো এক সমুদ্র গর্জন।
বিস্ফোরণের মতো করে গর্জে উঠলো হাজারো মানুষ। সারা শহর যেন কেঁপে উঠলো সেই গর্জনে। গোলের রেশ ফুরিয়ে যায়, কিন্তু গর্জন থামে না। মেক্সিকান ওয়েভের মতো করে তরঙ্গ হয়ে উঠতে থাকতে আওয়াজ-ব্রাজিল, ব্রাজিল।
কী ভাবছেন, কাতারের ‘স্টেডিয়াম ৯৭৪’ থেকে দেওয়া ধারাভাষ্য? নিদেনপক্ষে স্টেডিয়ামের আশেপাশের কোনো ফ্যান জোনের বর্ণনা? না, এখানেই কাতারকেও যেন টপকে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই জনসমুদ্রের বর্ণনা এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের মাঠ থেকে। যেখানে বিশ্বকাপ উপলক্ষে জমে উঠেছে স্টেডিয়াম আমেজের উৎসব। যে উৎসব নজর কেড়েছে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল থেকে শুরু করে খোদ ফিফা কর্মকর্তাদের। এই উৎসবের টানেই সারা ঢাকা তো বটেই, দেশের নানা প্রান্ত থেকে লোকেরা ছুটে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিন ‘নগদ’ এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করেছে বিশ্বকাপ দেখার উৎসব। তিনটি ভেন্যুতে জায়ান্ট এলইডি স্ক্রিনে খেলা দেখাচ্ছে তারা। সেই প্রতিষ্ঠানের একজন বলে কেবল বলে নয়, একজন দেড় দশকের ক্রীড়া প্রতিবেদক হিসেবে প্রাণটা আমার প্রথম দিন থেকেই এই ফ্যানজোরে পড়ে আছে।
আমরা যখন টিএসসি পৌঁছলাম, তখনও সন্ধ্যা ঘনায়নি। বিকেল বেলা; ক্যামেরুন-সার্বিয়ার খেলা চলছে। টিএসসিতে খুব বেশি লোক নেই, সোপার্জিত স্বাধীনতার সামনেও খুব জনসমাগম নেই। মহসিন হল মাঠে কিছু লোক এর মধ্যে চলে এসেছেন। লোকদের মুগ্ধ করে দুই দল একটার পর একটা গোল দিচ্ছে।
মজার ব্যাপার হল, এইরকম সমর্থনহীন ম্যাচে যা লোক এসেছেন, তারা দু পক্ষেরই ভালো খেলায় খুব করতালি দিচ্ছেন। সন্ধ্যা হয়ে এলো। দক্ষিণ কোরিয়া আর ঘানার খেলা। এবার লোক জমে উঠেছে। সব ভেন্যুতে দর্শক দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন। এশিয়ার দেশ বলে দক্ষিণ কোরিয়ার সমর্থন বেশি বলে মনে হলো। শেষ হাসিটা তারা হাসতে পারলেন না।
কিন্তু আমার ভ্রুতে একটু ভাজ পড়তে শুরু করেছে। একদিন আগে আর্জেন্টিনার ম্যাচে জনসমুদ্র হয়েছিলো তিন ভেন্যুতে। আজ কী ব্রাজিলের সমর্থক কম পড়লো?
প্রশ্নটা মনের ভেতর দাঁড়াতে সুযোগ পেলো না। তার আগেই বেজে উঠলো ভুভুজেলা। রাজু ভাস্কর্যের ওপাশ থেকে একটা মিছিল করে টিএসএসসির দিকে আসছেন একদল হলুদ জার্সি পরা সমর্থন। এই কেবল শুরু হলো; আসলে একটা বন্যার শুরু ছিল যেন। এরূপ স্রোতের মতো, বানের মত, ঝঞ্ঝার মতো তারা আসতে থাকলেন।
সে এক বিপুল জনরাশির স্রোত! হাজার হাজার, আক্ষরিক অর্থে হাজার হাজার হলুদ জার্সি; দু একটা ব্রাজিলের নীল এওয়ে জার্সি আছে। কারও পিঠে ব্রাজিলের পতাকা, কারও হাতে পতাকা, কারও হাতে ভুভুজেলা এবং সকলের মুখে ‘ব্রাজিল-ব্রাজিল’ রব। তারা আসছেই, তারা আসছেই।
এর মাঝে খুব সাহসী কিছু মানুষ আর্জেন্টিনার জার্সি পরেও চলে এসেছেন। তিন চার জনের ছোট একটা দল হাতে সুইজারল্যান্ডের পতাকা নিয়ে মিছিল করছেন; বুঝতে বাকী রইলো না, তারা কারা।
চোখের পলকে টিএসসির ময়দান উপচে পড়তে থাকলো। কখন যেন টইটুম্বুর হয়ে গেছে স্বোপার্জিত স্বাধীনতার চত্ত্বরটুকু। কিছু লোক কেবল এ পাশ ও পাশ করছেন একটু জায়গা পাওয়ার জন্য। দেখতে দেখতে রাজু ভাস্কর্যের চারপাশে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো। রাস্তায় রিকশা দাঁড় করিয়ে তার ওপর দাঁড়িয়ে গেছে মানুষ। কেবল মনে হচ্ছে, আর ঠাঁই নাই।
আমার বিভাগী প্রধান, নগদ-এর হেড অব পাবলিক কমিউনিকেশন্স জাহিদুল ইসলাম সজল এর মধ্যে চলে এসেছেন। একসময়ের দেশসেরা এই ইকোনমিক রিপোর্টার শুরুর জীবনে আমার মতই ক্রীড়া প্রতিবেদক ছিলেন। দু’জনে মিলে হিসাব করার চেষ্টা করছিলাম, এমন ভিড় খেলা উপলক্ষে শেষ কবে দেখেছি!
সোনালী যুগের আবাহনী-মোহামেডান, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারত-পাকিস্তান কিংবা এই যুগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা; কোনোটাই এই জনসমুদ্রের সঙ্গে তুলনীয় মনে হলো না।
হঠাৎ একটা তরঙ্গের মত আওয়াজ এ পাশ থেকে ও পাশে চলে গেলো; ‘ওহ হো’ শব্দ। কেনো? বাঁশি বেজে উঠেছে। খেলা শুরু হয়ে গেছে। রাস্তা থেকে জায়ান্ট স্রিগেন দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রতিটা পাসের অর্থ বোঝা যাচ্ছে। ব্রাজিল আক্রমণে এলে বুনো উল্লাস তৈরি হচ্ছে। আবার সুইজারল্যান্ডের পায়ে বল গেলে ‘আহ’ আওয়াজে নিস্তব্ধ জগত।
যারা স্থির হয়ে দাঁড়াতে পেরেছেন, তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছেন। যারা জায়গা পাচ্ছেন না, তারা ছুটছেন তখনও। এবার ছুটের উদ্দেশ্য মহসিন হলের মাঠ; বিশ্বকাপের মূল ভেন্যু!
জনস্রোতে হাঁটতে হাঁটতে কখন গুরুদুয়ারা পার হয়ে মহসিন হলের গেটে চলে এসেছি, বুঝতে পারিনি। কয়েক একরের এই মাঠে তিলটি আর ফেলার জায়গা নেই। সিনেমার মত এক দৃশ্য হাজার হাজার মানুষ শরীরে শরীর মিশিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কেবল থেমে থেমে স্লোগান আর খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেওয়া। বেজে উঠছে ভুভুজেলা। কিন্তু প্রাণ পাচ্ছে না।
এরই মধ্যে ‘গোল’! জেগে উঠলো দুনিয়া। যেন ছোট একটা মহাবিস্ফোরণ হলো। কিন্তু সে আওয়াজ শুরু হতেই থেমে গেলো-অফসাইড। এবার আর্জেন্টাইনদের মৃদু একটা গর্জন শোনা গেলো। আস্তে আস্তে একটু করে আশা কমে আসছে; সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর তখনই ক্যাসিমিরো পুরো শহরকে, পুরো দেশকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাগিয়ে তুললেন। শেষ সময়ের গোল; আর ভয় নেই। সমর্থকরা আস্তে আস্তে মাঠ ছাড়তে শুরু করেছেন।
মধ্য রাত পার হয়ে গেছে। শেষ বাঁশি বেজে গেছে। কিন্তু মাঠ এখনও পুরো ফাঁকা হয়নি। মাঠের মাঝখানে এখনো উৎসব চলছে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নেচে গেয়ে চলেছেন ব্রাজিল সমর্থকরা। একটু কাছে যেতে বোঝা গেলো, তারা চ্যাম্পিয়নশিপের উল্লাস শুরু করেছেন।
ওদিকে জায়ন্ট ক্রীনে গান বাজছে-দেশি নগদে বেশি লাভ। সমর্থকরা চিৎকার করছেন, দেশী নগদে বেশি ব্রাজিল!