কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে আজ রাতে মুখোমুখি হচ্ছে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান ঐতিহাসিকভাবেই বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচিত ও প্রাসঙ্গিক দুটি দেশ। এবারে বিশ্বকাপের মঞ্চেও এই রাজনৈতিক অস্থিরতার উত্তাপ পাওয়া যাচ্ছে।
যদিও বৈশ্বিক রাজনীতি এই ম্যাচে একটা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ম্যাচ নিয়ে অনেকেই খুনসুটিও করছেন, এই গ্রুপটিতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্ব রাজনীতির আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইংল্যান্ডের ফুটবল দলও আছে।
তবে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচের আগে আর খুনসুটির পর্যায়ে নেই আলোচনা। ইরানে চলমান দেশবিরোধী আন্দোলনের সাথে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশ করতে ইউএস সকার- যুক্তরাষ্ট্র ফুটবল দলের অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইরানের পতাকা দেয়া হয়নি আজকের ম্যাচের আগে।
এটাকে একটা প্রতিবাদ হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান এই ঘটনা নিয়ে ফিফার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানিয়েছে।
এছাড়া সংবাদ সম্মেলনেই উত্তাপ ছড়িয়েছে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের লড়াই, যেখানে জড়িয়ে গেছেন দুই দেশের সাংবাদিকরাও।
যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক টাইলার অ্যাডামসকে, আমেরিকায় বর্ণবাদ নিয়ে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে, ইরানের এক সাংবাদিক করেছেন এই প্রশ্ন।
স্কাই স্পোর্টসের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক টিম থর্নটন। উপস্থিত ছিলেন এই সংবাদ সম্মেলনে, নিজের বিশ্লেষণে এই সংবাদ সম্মেলনকে ‘অদ্ভুত’ বলেছেন টিম।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উদ্বেগ অনেক পুরনো এবং বহুল আলোচিত। তবে আজকের ম্যাচের আগে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কাতারে, ফুটবলে সচরাচর দেখা যায় না।
ইউএস সকার ফেডারেশন ইরানের আন্দোলনরত নারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের পতাকা সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইরানে ২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনির পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর পর যখন জানা গেছে হিজাব ঠিকমতো না পরার অপরাধে মৃত্যুর তিনদিন আগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
তখন ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিক্ষোভ। চারশো জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে সরকারবিরোধী এই বিক্ষোভে, ইরানের ক্ষমতাসীনরা স্মরণকালে এতো বড় বিক্ষোভের মুখোমুখি হননি।
যুক্তরাষ্ট্র এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ইরানের এমন একটি পতাকা ব্যবহার করেছে যেটা ইরান স্বীকৃত নয়। এ নিয়ে ফিফার কাছে ইরান কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে।
ইউএস সকার এমন একটি পতাকা ব্যবহার করেছে যেখানে ইসলামিক বাণী ও প্রতীক নেই, ১৯৮০ সালে ইরানের পতাকায় এই প্রতীক যোগ করা হয়েছিল।
ইউএস ফেডারেশন বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইরানে মৌলিক অধিকার চেয়ে লড়াই করা নারীদের সমর্থন জানাতে’ এই প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা।
তবে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে এবং ইরানের পতাকা যোগ করা হয়েছে সেখানে। বিশ্বকাপের আয়োজক কর্তৃপক্ষ কাতার স্টেডিয়ামে ইরানের পুরনো পতাকা বহন করা রোধের চেষ্টা করছে, এমনকি কাতার কর্তৃপক্ষ বিশ্বকাপের খেলায় ইরানে চলমান আন্দোলনের স্লোগান – “নারী জীবন স্বাধীনতা” লেখা কোনও টি-শার্ট পরেও কাউকে অনুমতি দিচ্ছে না।
প্রায় ৪৩ বছর ধরে ইরানে পুরুষ ফুটবল ম্যাচে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এসব ইস্যু মিলিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ফুটবলার ও কোচদের ফুটবলের বাইরের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে সেসব প্রশ্নের সামনে সচরাচর তাদের পড়তে হয় না।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কোচ গ্রেগ বারহল্টারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেন ইরানের পতাকা ইউএস সকার ফেডারেশন সোশাল মিডিয়ায় দেয়নি। কোচ বলেন, এটা নিয়ে তার কোনও ধারণাই নেই। এটা ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত।
“যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলাররা ইরানের বিপক্ষে খেলতে মুখিয়ে আছে। আমাদের মধ্যে যেসব আলাপ হচ্ছে তার পুরোটাই ফুটবল নিয়ে।”
যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক টাইলার অ্যাডামসকে ইরানের এক সাংবাদিক আমেরিকায় বর্ণবাদ নিয়ে প্রশ্ন করেন।
ইরানের কোচ কার্লোস কুইরোজকে ইরানের সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এক সাংবাদিক। উভয় দলের কোচই যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন খেলার দিকে আলোচনা নিয়ে আসার।
কুইরোজকে প্রশ্ন করা হয় ইরানের পতাকা নিয়ে, তিনি উত্তর দেন, “আমরা মাঠে জয়ের চেষ্টা করবো। এতে ইরানের মানুষ আনন্দ পাবেন।”
১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি হয়েছিল সেই ম্যাচে ইরান ২-১ গোলের জয় পেয়েছিল।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে ইরানের প্রথম ম্যাচ জয় ছিল সেটা। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘রাজনৈতিক’ ম্যাচ মনে করা হতো এই ম্যাচটিকে।
বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার প্রায় ছয় মাস আগে যখন গ্রুপ নির্ধারিত হয়েছিল তখন থেকেই আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওই গ্রুপে ছিল জার্মানি, ইউগোস্লাভিয়া, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের সময় হোক কিংবা ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের ম্যাচে অথবা আজকের ম্যাচ, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে একই রকম আছে, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায় ভরা।
২৪ বছর আগের সেই ম্যাচে ইরানের ফুটবলাররা মাঠে নামার আগে করমর্দনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলারদের ফুল দিয়েছিলেন। এটা বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সবচেয়ে আলোচিত দৃশ্যের একটি ছিল।
তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার এই সম্পর্কের কারণেই ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচ কেবল ফুটবল নিয়ে আলোচনা হয়ে ওঠেনা সাধারণত। ইরান এই বিশ্বকাপের অন্যতম রাজনৈতিক চরিত্র সেটা বোঝা গেছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই।
যখন তারা জাতীয় সংগীত গাইতে অস্বীকৃতি জানালো।এরপরের ম্যাচে তারা ফুটবলেও প্রমাণ দিল, ওয়েলসকে ২-০ গোলে হারিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত দুটি ড্র করেছে, দুই ম্যাচে দুই পয়েন্ট। আজ যে দলই জিতবে, তারা শেষ ১৬-তে খেলা নিশ্চিত করবে।