বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল ষাটের দশকের শেষের দিকে। সে সঙ্গে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশও সাধিত হয়। এরকম আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যার সূচনা। চলচ্চিত্রটির মধ্যে আগামী দিনের উত্তাল বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা ছিল। এটি সম্পূর্ণভাবেই রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির তাই এ চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণ-অভ্যুত্থান যখন তুঙ্গে, তখন জহির রায়হান জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এ গণ-আন্দোলন জহির রায়হানকে চলচ্চিত্রটি নির্মাণে সাহস যুগিয়েছিল এবং অনুপ্রাণিত করেছিল। চলচ্চিত্রটি গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য পূর্ববাংলার জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। খোলাখুলি রাজনৈতিক বক্তব্য, পূর্ববাংলার স্বাধিকার, জনগণের সংগ্রাম অনেকটা পোস্টারের ভাষায় ‘জীবন থেকে নেয়া’য় ধরা পড়ল। জহির রায়হানের লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্রকে জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামের, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। গণ-আন্দোলনে শরিক মানুষ হাজারে হাজারে ‘জীবন থেকে নেয়া’ দেখেছে, উদ্বুদ্ধ হয়েছে। জীবন থেকে নেয়া আসলে একটি ছবি ছিল না; এটি ছিল একটি আন্দোলন। বাঙালির জাতীয়তাবাদ ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। রাজনৈতিক বক্তব্য শৈল্পিক ও সুস্পষ্টভাবে প্রতীকের মাধ্যমে উপস্থাপনের এমন দৃষ্টান্ত এদেশের আর কোনো চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের প্রথম গণ-আন্দোলনভিত্তিক এ চলচ্চিত্রে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির মর্মস্পর্শী চিত্রায়ণ রয়েছে। গানটি পরিবেশনের সময় প্রভাতফেরি দৃশ্য পর্দায় প্রতিফলিত হয়। যে রবীন্দ্র সংগীতটি এ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে এটি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। এ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসংগীতটি হচ্ছে :‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি।’ চলচ্চিত্রে দুইটি নজরুল সংগীত ব্যবহৃত হয়। এগুলো হচ্ছে :‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙে ফেল কররে লোপাট/রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণবেদী।’ এবং ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের/এ শিকল পরা ছল।’ এছাড়াও খান আতাউর রহমানের কথা, সুর ও কণ্ঠে গাওয়া ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও খান আতাউর রহমানের সুরে এবং সমবেত কণ্ঠে ‘দাও দাও দাও দাও/দুনিয়ার যত গরিবকে আজ জাগিয়ে দাও ’ গানটি পরিবেশিত হয়।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি চলাকালীন সময়ে দেখানো হয়েছে ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদ বরকত ও সালাম-এর কবর, শহিদ মিনারের সামনের কালো পিচের রাস্তায় আঁকা আলপনা। এ চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখি রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা আনোয়ার ‘অমর একুশে’ প্ল্যাকার্ড লিখছেন, দুই বোন সাথী-বীথিসহ একুশের প্রভাতফেরিতে গান গাইছেন। ছবির শেষ দৃশ্যেও দেখি শহিদ মিনারে সমবেত সাথী, বীথি, আনিস, ফারুক, মেহরাব ও আনোয়ার ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায়। ভবিষ্যৎ শোষণমুক্ত স্বদেশ বিনির্মাণে তারা দোয়া কামনা করে। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির ঐ সংসারটির অবস্থান কিংবা তার পাশাপাশি একুশের প্রভাতফেরি, কিংবা রাজবন্দিদের মুক্তি চাওয়া কোনোটাকেই বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয় না। ঘর-বাহির, দেশ-বিদেশ সব যে একাকার হয়ে যায়—সেটা কিছুটা প্রতীকী হলেও দর্শক তাতে মিশে যেতে পারে। পুরো ছবির মধ্যে অতি নাটকীয় ভাব ছবিটির সুষম বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবু ডকু-ফিকশান আঙ্গিকের এ ছবিটি উচ্চমাত্রার নাটকীয় প্রকাশভঙ্গি সত্ত্বেও আমাদের অন্তরকে ছুঁয়ে যেতে চায়।
প্রতীকের মাধ্যমে দেশীয় রাজনীতির চিত্র এতে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া মুক্তি পায়। এ প্রথম আমরা রাজনীতি প্রত্যক্ষ করলাম। বলা যায়, ১৯৬৮-৬৯ সালের গণ-আন্দোলন জহির রায়হানকে এ ছবি নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে। এখানে প্রতীকের মাধ্যমে দেশীয় রাজনীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এ কারণে ছবিটি একদিকে হেঁয়ালিতে পরিণত হয়, আবার অন্যদিকে মেলোড্রামায় ভরপুর ছবির প্রধান চরিত্রগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে না।
জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রটি ঘৃতাহুতি দিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও যুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর জীবন থেকে নেয়া এই দুইটি শব্দ অনেক ক্ষেত্রে সমার্থক হয়ে উঠেছিল। দেশের অভ্যন্তরে থেকে একদিকে সামরিক একনায়কের রক্তচক্ষু আর অন্যদিকে মুনাফালোভী প্রযোজকের শ্যেনদৃষ্টিকে উপেক্ষা করা, দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সোচ্চার একাত্মতা ঘোষণা করা এবং দর্শককে প্রয়োজন হলে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উত্সাহিত করার মতো যে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রের মধ্যে দেখতে পাই তার নজির মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে বিরল।