এসএসসি, দাখিল ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সব সাধারণ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে এবার মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২১ হাজার ৮৬৮ জন। তন্মধ্যে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ শিক্ষার্থী। নিঃসন্দেহে এই বহুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ প্রাপ্তি আমাদের আনন্দিত করে। কিন্তু যখন আমরা দেখতে পাই আমাদের চারপাশে অসংখ্য কিশোর শিক্ষার্থী কেবল জিপিএ ফাইভ না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ছে, কখনো কখনো আবার এটি তাদেরকে আত্মহননের দিকেও ঠেলে দিচ্ছে, তখন একটি প্রশ্ন মনে তৈরি হয়, জিপিএ ফাইভই কি সব?
‘জিপিএ ফাইভ পেতেই হবে’—কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিভাবকদের থেকে এমন চাপ থাকে সন্তানের ওপর। যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। জিপিএ ফাইভ পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ না দিয়ে বরং তাদের বলা উচিত—‘পড়ো, জানো, শিখো। সমাধান করতে শেখো।’ এসব কথা তাদের মাথায় ঢোকাতে পারলে সত্যিকার অর্থেই তাদের অর্জিত বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে চারপাশের সমস্যা সমাধানের জ্ঞান উৎপাদন করার সক্ষমতা আরো ভালোভাবে অর্জন করা সম্ভব।
জিপিএ ফাইভ নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীদের মেধা, শ্রম ও ত্যাগের স্বীকৃতি দেয়। অভিনন্দনও তাদের প্রাপ্য। কিন্তু এই জিপিএ ফাইভের অতিমাত্রার ‘গ্লোরিফিকেশন’ সমাজ ও জাতীয় জীবনে সাধারণ হয়ে গেলে তা সমস্যা ও সংকটের সৃষ্টি করে। তাই আমাদের অভিভাবকদের এক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। আর্থসামাজিক বাস্তবতায় জিপিএ-৫-এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য বটে, কিন্তু জিপিএ ফাইভকেই যেন আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন ও জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে না দিই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বুঝ থাকে না, তাই সন্তানের সঠিক পরিচর্যার দায়িত্ব পিতামাতাকেই নিতে হবে।
জিপিএ ফাইভই সব নয়। হতে পারে জিপিএ ফাইভ প্রাপ্ত একজন শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ না পাওয়া শিক্ষার্থীর চেয়ে অন্যান্য একাডেমিক দিক থেকে এগিয়ে। তার মানে এই নয় যে, জিপিএ ফাইভ না পাওয়া শিক্ষার্থীটি মেধা ও যোগ্যতায় ঐ শিক্ষার্থীর চেয়ে পিছিয়ে। বরং দক্ষতা-যোগ্যতায় সে ঐ শিক্ষার্থীর চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে থাকতে পারে। হতে পারে তা খেলাধুলায় কিংবা সংগীত বা অভিনয়ে! হতে পারে কম্পিউটার শিক্ষায় কিংবা সাহিত্যে। সুতরাং, সন্তানের এই নির্দিষ্ট গুণ, প্রতিভাকে মূল্যায়ন করুন। পরিচর্যা করুন। তাকে তার প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠতে দিন। মাছ গাছে নয়, পানিতেই বাঁচে। প্রতিটি শিক্ষার্থী, প্রতিটি তরুণ একেকটি সম্ভাবনা। তাদের সেই সম্ভাবনাকে জিপিএ ফাইভের মতো সীমিত মানদণ্ডে যাচাইয়ের মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। জিপিএ ফাইভই লাগবে—এমন চাপ সন্তানের মাথা থেকে নামান। তাকে বলুন, ‘জানো। জানো। শেখো।’ জিপিএ ফাইভ না পেলেও তার ফলাফল উদযাপন করুন।
যুগে যুগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সফলতার শীর্ষে পৌঁছানোর বহু দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই আছে। তবুও কেন আমরা ধরে নিই যে, যে জিপিএ ফাইভ পেল না, যে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারল না, যে ভালো নম্বর পেল না, সে ব্যর্থ হয়ে গেল?
আমাদের এই ধরে নেওয়াটা যতটা না জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তদের উত্সাহিত করে, তার চেয়েও বেশি জিপিএ ফাইভ না পাওয়া শিক্ষার্থীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে। শুধু তাই নয়, এই ধ্যান-ধারণা যখন ব্যক্তি পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে কর্তাব্যক্তিদের মননেও পৌঁছে যায়, তখন জাতি পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। কেবল সনদই তখন যোগ্যতা বিচারের মানদণ্ড হয়ে পড়তে পারে! কাজেই, আমাদের সকলকে মননের সুস্থতা ধরে রাখতে হবে। শিক্ষার সঠিক উদ্দেশ্য লালন করতে হবে। দেশব্যাপী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সমাজকেও স্পষ্টভাবে বুঝাতে হবে এই উদ্দেশ্য। বাস্তবিকভাবে, জিপিএ ফাইভ নয়, বরং সৎ ও দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্যই সন্তানকে স্কুলে পাঠানো হয়। সত্যি বলতে, মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এটাই।