প্রকৃতির রূপবদলের ধারাবাহিকতায় শিশিরভেজা প্রভাতবেলায় হিমেল হাওয়ায় পরশ লাগিয়ে প্রকৃতিভূমে শীতের ছোঁয়া নতুনত্বের সূচনা ঘটায়। সোনালি রোদের ঝলক লাগিয়ে রুক্ষ-শুষ্ক-বির্বণ আলোয় শীতকালের আবির্ভাব প্রবহমান প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। হেমন্তের সোনালি ডানায় ভর করে কুয়াশার উত্তরীয় তলে সহজ-সরল জীবনধারায় পরিবর্তনের ঢেউ তোলে শীত মৌসুম। শীতের সমীরণ আর জনজীবনের নানামুখী পরিবর্তন—আবহমান গ্রামবাংলার চিরায়ত দৃশ্য। খেজুরের রস, পাটালি গুড়, পিঠা-পায়েস, লেপ-কম্বলের উত্তাপ, কুয়াশাঢাকা ভোরের শিশির ভেজা ঘাস—এসবই বাঙালির জীবনধারাকে রাঙিয়ে তোলে আনন্দ-উল্লাস আর অপার প্রাণোচ্ছ্বলতায়। আমোদ-আহ্লাদের এই সচলতার ভিড়ে হিমশীতল শীতের করুণ আখ্যানে ঢাকা পড়ে যায় অসহায়, ছিন্নমূল, সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের জীবন।
ঋতু বদলের পরিক্রমায় প্রকৃতিতে স্বরূপে ফিরেছে শীত। কিন্তু ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে এবারের শীতের আবির্ভাব—বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও অসময়ে ঋতু বদলের ধারাবাহিকতায় এবারের শীতের প্রকোপ কয়েক গুণ বাড়বে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। শীতের তীব্রতা অতিবৃদ্ধি বরাবরের মতোই সবচেয়ে বেশি ভোগাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে। ফিবছর শীতের প্রকোপে নাকাল হয় দেশের উত্তরাঞ্চল, হাওরাঞ্চল এবং শহরের ভাসমান মানুষের প্রাত্যহিক জীবন—এ কথা কে না জানে? দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগাতে ব্যতিব্যস্ত মানুষজন শীতের দাপটে নিতান্তই অসহায় হয়ে পড়ে। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-নগরে হাড়কাঁপানো ঠান্ডার নির্মমতা থেকে বাঁচতে এসব মানুষের প্রাণান্তকর চেষ্টা প্রতিটি বিবেকবান মানুষের চোখ ভিজিয়ে দেয়! একটুখানি উষ্ণতার ছোঁয়া পেতে হন্যে হয়ে ফেরা শীতার্ত মানুষের অবিরাম প্রচেষ্টার হাজারো আত্মকথা লেখা হয় ‘শীত মহাকাব্যে’। শীতের নির্মমতার কশাঘাতে খাবি খাওয়া মানুষ যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে—এ এক নির্মম দৃশ্য!
সমাজের অবহেলিত মানুষকে শীতের নিদারুণ কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দিতে প্রতি বছর শীত মৌসুমে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সহায়তা প্রদান করা হয়। বলা বাহুল্য, এই সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এক্ষেত্রে সঠিক বণ্টনের অভাবের কথাও শোনা যায়, শোনা যায় অনিয়মের কথাও। এ বিষয়টি মাথায় রেখে এবার শীতবস্ত্র বিতরণে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা অতি জরুরি। এবার যেহেতু শীতের প্রকোপ বেশি হবে, তাই সবার উচিত হবে সহযোগিতার হাতকে আরো বেশি প্রসারিত করা। বিশেষ করে বিত্তবানসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে উদার হাতে। বিলাসিতাকে পাশ কাটিয়ে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষাকে বিকশিত করতে পারে তরুণপ্রজন্মও। মানবতার দেওয়াল হয়ে মানুষের জন্য নিজেদের উত্সর্গ করার মহান কাজে সব থেকে বেশি অগ্রগামী সমাজের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা—এ সত্য মানতে হবে। শীত মৌসুমে একদিকে বাড়তে থাকে শীতের কাঁপুনি, অপরদিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে হাজির হয় নানা রকম সংক্রামক রোগব্যাধি। ফলে দরিদ্র মানুষের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সে জন্য শিশু ও বৃদ্ধদের প্রতি একটু বেশি খেয়াল রাখতে হবে নিজ নিজ জায়গা থেকে।
বলতেই হয়, শীতের কবলে কাঁপতে থাকা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে, তাদের প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আমার-আপনার-আমাদের সবাইকে। সামান্য একটু মানবিকতার স্পর্শ বাঁচাতে পারে শীতার্তদের, তাদের মুখে ফুটিয়ে তুলতে পারে খুশির ঝিলিক। কিশোরকবি সুকান্ত যেমন করে সূর্যের কাছে উত্তাপ চেয়েছিলেন ‘পথের ধারের উলঙ্গ ছেলেটির জন্য’, তেমনিভাবে আমাদের মধ্যে এই শীতে মানবিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। ক্রমশ জেঁকে বসা শীতে একটুখানি উষ্ণতার আশায় প্রহর গুনতে থাকা সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কিছু সময়ের জন্য নিজেদের আরাম-আয়েশকে দূরে ঠেলে শীতে কাঁপতে থাকা মানুষের দুঃখ লাঘবে এগিয়ে আসতে হবে। দিনশেষ আমরা যেন ভুলে না যাই—‘মানুষ মানুষের জন্য’।