গুজবের বাজারে এখন হট আইটেম ব্যাংক। এর আগে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার দশায় চলে গেছে বলে ধুয়া চলেছে কদিন। কার্যত বাংলাদেশ তা হয়নি। এমন একটি ভয়ংকর গুজবের ঝড় তোলার বিহিত হয়নি। কাউকে জবাবদিহি করতে হয়নি। পর্দায় এখন গুজবের পরবর্তী অ্যাপিসোড : রিজার্ভ শেষ, বাংলাদেশ দেউলিয়ার পথে, ব্যাংকে টাকা নেই, গ্রাহকরা জমাকৃত টাকা ফেরত পাচ্ছে না, কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। এসব গুজবে মানুষকে আতঙ্কে ফেলতে পেরেছে আয়োজকরা। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক ১৩ নভেম্বর জরুরি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে কোনো ব্যাংক বন্ধের রেকর্ড নেই’।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই গুজবের আওয়াজে জিকির তোলার কাজটি এ বঙ্গে মুখরোচক। গুজবকে বাঙালি জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলা হয়েছে গদ্য-পদ্যসহ বিভিন্ন লেখনীতে। গুজবে সত্য-মিথ্যা থাকে, সঙ্গে থাকে বিনোদনও। তবে, অনেক ক্ষেত্রেই বিনোদিত করা আসল উদ্দেশ্য নয়। মূল মতলব মানুষকে আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত করা। কুশীলবরা গুজব-গুঞ্জন রটানোর সুযোগটা নেয় কোনো সংকটকে পুঁজি করে। হালে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে তা করছে বিদ্যমান অর্থনৈতিক টানাপড়েনের সুযোগে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাংক খাত স্পর্শকাতর। যেনতেন সেক্টর নয়। অর্থনীতির অন্যতম এ অংশটি নিয়ে মনগড়া কথা বা তথ্য রটানো যেনতেন অপরাধ নয়। তার ওপর সময়টাও কঠিন।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধকল, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বময় স্নায়ুযুদ্ধসহ স্থানিক নানা কারণে সব দেশই কম-বেশি ভারাক্রান্ত। বাংলাদেশের অর্থনীতিও প্রবল চাপে। সেই তাপ পড়েছে ব্যাংক খাতেও। তাই বলে দেউলিয়া হয়ে যাবে, চম্পট দেবে—এমন অবস্থায় যায়নি। এ নিয়ে অর্থনীতিকদের চেয়ে বেশি কথা বলছেন রাজনীতিকরা। যাদের অর্থনীতি বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। কারো কারো একদমই নেই। মুখজোরে আগুয়ান এ মহলটির কোনো দায়দায়িত্বও নেই। তারা কেউ বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা বানিয়ে ছাড়েন। কেউ সিঙ্গাপুর বানিয়ে ফেলেন। ইচ্ছেমতো অর্থনীতির পোস্টমর্টেম করেন তারা।
বুঝদার অর্থনীতিক বা অর্থনীতি বিষয়ক ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই এ ধাঁচের মূল্যায়ন করবেন না। তারা তথ্য-সাবুদে দেখিয়ে দিতেন সরকারের দাবির অসারতা বা সত্যতা। প্রধানমন্ত্রীর ‘পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ আছে, ব্যাংকে টাকার ঘাটতি নেই’ দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করতে নিশ্চয়ই বাধা নেই। তা না করে ‘নয়কে ছয় বা ছয়কে নয় বানানোর’ নোংরামি ছড়ানো হচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা যাবে বাংলাদেশ নেই, ব্যাংক গায়েব হয়ে গেছে—ধরনের শিশুতোষ কথা পয়দা করা ব্যক্তিদের কেউই অর্থনীতিক নন, অর্থ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্তও নন। রাজনৈতিক এ অ্যাক্টিভিস্টদের কোনো কথারই দায়িত্ব নিতে হয় না। হাওয়াই মিঠাইর মতো কথার নামে কুকথা ছড়িয়ে দিয়েই তারা কুল্লে খালাস। এরপর একটা তামাদি রেখে আরেকটা ধরেন।
অর্থনীতি নিয়ে এ ধরনের মিশ্রতায় বিদেশিরা দ্বিধায় পড়ছে। বাংলাদেশ নিয়ে বাংলাদেশের কারো কারো যত ‘গেল গেল’ চিত্কার তা আন্তর্জাতিক মহলে নেই। বৈদেশিক নানা সংস্থা বরং বাংলাদেশকে ‘চাপে আছে কিন্তু ঝুঁকিতে নেই’—পজিশনে দেখছে। কিন্তু, বাংলাদেশে ঘুরছে ‘সকালে ঘুম থেকে জেগে আর বাংলাদেশ না দেখা, ব্যাংকগুলো হাওয়া হয়ে যাওয়ার’ শঙ্কাবার্তা।
মূল্যস্ফীতি, বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দাম, ব্যাংকে খরার টান, বা ডলার ঘাটতি অবশ্যই সত্য। কিন্তু, তা কোন পর্যায়ে? চাইলেই এখন আগের মতো ফ্রি-স্টাইলে এলসি খোলা যাচ্ছে না। নিট হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ডলারে ভর করে ১৩ মাস আগেও যে রিজার্ভের রমরমা অবস্থা ছিল, সেখানে এখন খরার টান। চাইলেও বাংলাদেশ ব্যাংক হাত খুলে ডলার খরচ করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৬৬ শতাংশ মূলধনী যন্ত্রপাতি, ১৪ শতাংশ শিল্পের কাঁচামাল ও ১৪ শতাংশ মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। ডলার দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় ঋণপত্র খোলা কমেছে। ২০টির মতো ব্যাংক কম জরুরি পণ্যের আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের চাহিবামাত্র ঋণপত্র খুলতে কৃপণতা করছে।
বিভিন্ন সংস্থার জরিপে এখন দেখা যাচ্ছে, রিজার্ভের টাকার একটা অংশ প্রথমে টাকায় কনভার্ট হয়ে-তস্করদের মাধ্যমে পুনরায় ডলারে রূপান্তর হয়ে চলে গেছে ক্যানাডা, সুইজারল্যান্ড আর মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ ওভার ইনভয়েসিং করে বেশ কিছু বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করেছে। ব্যাংকগুলোর কঠোরতার কারণে তা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। টাকা না পেয়ে বাড়তি কিছু অভিযোগ ও হাহাকার জুড়ে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে নালিশ করেছেন কিছু গ্রাহক। যারা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে বেশ পরাক্রমশালী। তাদের অভিযোগ ও বেদনাকেই তথ্য হিসেবে বাজারজাত করে দেওয়া হয়েছে। সত্যকে বিকৃত ও অপব্যাখ্যা করে অভিযোগকে একতরফা বিবেচনায় নিয়ে বলা হচ্ছে, ব্যাংকের ভান্ডার খালি হয়ে গেছে! বহু ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! আসলে কি তাই? টানাটানি আর ভান্ডার শূন্য হয়ে যাওয়া কি এককথা? কোনো নিত্যপণ্যের আমদানি বিল পরিশোধে কি দেরি করছে কোনো ব্যাংক? এরই মধ্যে ব্যাংকিং খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য আছে বলে নিশ্চিত করেছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকের আমানত তুলে নিতে হুলস্থুল মর্মে প্রচারণার জেরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ় অবস্থায় আছে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্যের কোনো সংকট নেই। ব্যাংকে জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ আছে জানাতে গিয়ে এমনো বলেছে, কোনো ব্যাংক টাকা না দিতে পারলে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দেবে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চলতি বছর ১০ নভেম্বর পর্যন্ত এলসি খোলা হয়েছে ১ হাজার ২৬৩ মিলিয়ন ডলার। গত মাসের এ সময়ে ছিল ১ হাজার ২৩২ মিলিয়ন ডলার। এর আগে, অক্টোবরে এলসি খোলা হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৩ মিলিয়ন ডলার।
অঙ্কসহ এমন হিসাব জানানোর পরও কেন, কোন উদ্দেশ্যে ব্যাঙের সর্দি ঝরাতে এত ঘাম ঝরানো? বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবির মধ্যে ফাঁক থাকলে সুনির্দিষ্টভাবে ধরিয়ে দিতে সমস্যা কী? তবে কি আগের মতো ব্যাংকিং সেক্টরে দেদার সুবিধা লুটতে না পারার বেদনায় এসব ভয় ছড়ানো? এর নেপথ্যে কারা? সরকারকে ঘায়েল করতে গিয়ে দেশের অর্জনগুলোকেই বিসর্জনে নেওয়ার এ নোংরা খেলার লাগাম টানতেই হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের অর্জনগুলো এমনি এমনি আসেনি। এর পরতে পরতে রয়েছে অনেক কষ্ট ও স্বপ্নগাথা। ২০১৫ সালে ঢাকা সফরে এসে বিশ্বব্যাংকের তখনকার প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশকে দেখেছেন ‘এশিয়ার ইমাজিং টাইগার’ হিসেবে। প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৯তম দেশ। দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশটিতে দারিদ্র্য হ্রাসের এ সাফল্যকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করছে বিশ্বব্যাংক।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, জলাবদ্ধতা, নদীর নাব্য হ্রাস, পানির স্তর নেমে যাওয়া, ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা প্রতিনিয়ত হুমকিতে পড়ছে। অর্থনীতি পড়ছে ঝুঁকিতে। তার ওপর উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত শিল্পায়নের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ধকল সইতে হচ্ছে। এর মধ্যেই কেবল টিকে থাকছে না, বারবার ঘুরেও দাঁড়ায় বাংলাদেশ। বিরতিহীনভাবে দেশের অর্থনীতির গতিময়তা পাচ্ছে। বাজেট বাড়ছে। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ঘোষিত বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ৫০ বছর পর চলতি বাজেটটি ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। বাজেটের আকারের এই বিশাল পরিবর্তনের সমান্তরালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও তাক লাগানো।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ—সিইবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহত্ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে অবস্থান ৪১তম। ২০৩৩ সালে আমাদের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ১২টি দেশকে টপকে গেছে। আগামী ১৫ বছরে টপকে যাবে আরো ১৭টি দেশকে। এমন আশা জাগানিয়া সাফল্যের পেছনে বিশেষভাবে কাজ করেছে অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন। স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার পরের এক দশক বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরেছে কৃষিকে ঘুরে। এখন কেবল কৃষি নয়, শিল্প ও সেবা খাতও অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছে। এ চাকা থমকে দেওয়ার যে কোনো তত্পরতা রুখতে হবে শক্ত হাতে।