‘নারী’ দুটি বর্ণের একটি শব্দ, যার পেছনে রয়েছে সমাজ গড়ার বিশাল এক কারিগর অংশের অবদান। আজ আমরা নারীর স্বাধীনতা, সমতা, অধিকার নিশ্চিত করা প্রভৃতি সচেতনতামূলক বিষয়ে আলোচনা করলেও বাস্তবে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কি আদৌ সম্ভব হয়েছে? পত্রিকা খুললেই প্রতিদিন নারীর প্রতি সহিংসতার নির্মম চিত্র দেখা যায়। আর ধর্ষণ যেন এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের পরিসংখ্যান নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে মোট ১ হাজার ১১৭টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে প্রায় ১০ জন ধর্ষণের শিকার হয়, যা অত্যন্ত লজ্জাকর একটি বিষয়। নারীর প্রতি সহিংসতা দিনে দিনে যেন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে।
এ তো গেল শুধু ধর্ষণের ঘটনা, এছাড়া নারী উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পথে-ঘাটে, যানবাহনে, অফিস-আদালতে নানাভাবে নারী হেনস্তার শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি ব্র্যাকের প্রকাশিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী উত্ত্যক্ত, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। দেশের ৬৬ শতাংশ নারী ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সি পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হয়।
এছাড়া গৃহস্থালির কাজের ক্ষেত্রেও নারী মানসিক চাপে থাকে। সাধারণত আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারীরাই গৃহের সব কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে গিয়ে নারী নিজের যত্নের, এমনকি খাওয়াদাওয়ার কথাই ভুলে যায়, যার ফলে তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। আর এভাবেই নারী নানা অবহেলার মধ্য দিয়ে, হাজারো না পাওয়ার মধ্য দিয়ে নিজের জীবনচক্র শেষ করে।
তবে এভাবেই কি চলবে নারীর জীবন? একবিংশ শতাব্দীতেও কি নারী এভাবে অবহেলিত হতে থাকবে? নাকি নারীর এই অবস্থার পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, সহংসিতা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কথা বলা হলেও প্রয়োজন যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া। এক্ষেত্রে নারীকে সর্বপ্রথম প্রতিবাদী হতে হবে। পথে-ঘাটে হয়রানির ক্ষেত্রে নারী লোকলজ্জার ভয়ে চুপ থাকে, এতে অপরাধী সুযোগ পেয়ে যায়। নারীকে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করতে হবে। রাতে চলাফেরার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। প্রতিটি যানবাহনে নিরাপত্তার জন্য স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা ব্যবহার ও তার যথাযথ মনিটরিং করতে হবে। নারীকে আত্মরক্ষামূলক প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে বিপন্ন পরিস্থিতিতে সে নিজেকে সাময়িকভাবে রক্ষা করতে পারে। এছাড়া নারীর সুস্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। গৃহস্থালির কাজে পুরুষকেও দায়িত্ব নিতে হবে। সংসারের কাজগুলো ভাগাভাগি করে নিলে নারীর ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমবে এবং নারী নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে। এছাড়া গণমাধ্যমে নারীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা যাবে না। লিঙ্গ, সমতা, সম্মান ও মানবাধিকারের বিষয়ে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে হবে এবং পুরোনো কুসংস্কারগুলো পরিহার করতে হবে।
নারী-পুরুষের সমতার বিষয়ে শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে এবং আদরের নামে খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে তাদের ছোট থেকেই অবহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শিশুদের অভিযোগগুলো মন দিয়ে শুনতে হবে। সহিংসতার শিকার এমন নারীকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র, হটলাইন, পরামর্শের ব্যবস্থার মাধ্যমে সাহায্য করতে হবে। এসবের পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নারীর অধিকার ও সম্মানের বিষয়ে আলোকপাত করতে হবে এবং নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। গণমাধ্যমগুলোতে নারী সহিংসতাবিরোধী জোরালো প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। সর্বোপরি সহিংসতা সম্পর্কিত দেশে প্রচলিত আইনের যথাযথ ও বিচারকার্যের দ্রুত বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে অন্য কেউ এ ধরনের অপরাধ করার মতো সাহস না পায়।
দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, এই একবিংশ শতাব্দীর আলোর বিশ্ব নারীকে তার প্রাপ্য-যথাযথ অধিকার ও নিরাপত্তা দিতে পারেনি, যার দায় আমরা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করা, হারানো অধিকার ও সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে উন্নয়ন, সাজসজ্জা ফিকে আর মেকিতে পরিণত হবে। বেগম রোকেয়ার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়, ‘গাড়ির একটি চাকা ছোট এবং অন্যটি বড় হলে যেমন গাড়ি চলতে পারে না, তেমনি সমাজও নারীকে পিছিয়ে রেখে, তাকে শোষণ ও নির্যাতন করে এগোতে পারবে না।’