একটা ছোট্ট শিশু। সম্ভবত ছয় কি সাত বছরের হবে। সেই নিষ্পাপ শিশুর শরীর খণ্ডবিখণ্ড! তাও আবার এক-দুই টুকরো নয়, একবারে ছয় টুকরো! চোখ বন্ধ করে কল্পনা করেন তো! কিংবা ভাবেন তো, শিশুটি আপনার কোনো স্বজন-আপনজন। শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়; বুকে ভয়ের সমুদ্র জেগে ওঠে নিশ্চয়। কী ভয়ানক দৃশ্য! গ্রাম্য একটা প্রবাদ আছে—যার যায় কেবল সে-ই বোঝে। চট্টগ্রামে সম্প্রতি শিশু আয়াতকে যে নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা এক ট্র্যাজিক হিস্ট্রি। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদেরকে যারপরনাই স্তম্ভিত করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের দায় কার? এর সোজাসাপটা উত্তর হলো, আমাদের সবার। আমরা দেখেছি, আয়াতের নিখোঁজের প্রচারণা হয় ফেসবুকে। ফেসবুকেই বিষয়টি ভাইরাল হয় এবং মূলত এর পরেই বিষয়টি সবার নজরে আসে। এক্ষেত্রে বলতে হয়, দেশের গণমাধ্যমগুলোর আরো বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। গণমাধ্যমের ওপর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, নির্ভরতাকে যদি প্রাধান্য দেওয়া না হয়, তাহলে তা গণমাধ্যমকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে। অনেকেই যুক্তি দেখাতে পারেন, গণমাধ্যমে সংবাদ হলেও কী আসত-যেত? কেননা, আয়াত তো তত দিনে মৃত। এই প্রসঙ্গে বলতে হয়, আয়াত মৃত—এই তথ্য আমরা কিংবা আয়াতের পরিবার কেউই জানত না। আমরা জীবত-সুস্থ আয়াতেরই অপেক্ষা করেছিলাম। ঠিক হুমায়ূন আহমেদের ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসের মতোই। আয়াত নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা তার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় বুক বেঁধেছিলাম।
সত্যিকার অর্থে, আমাদের সমাজে অমানবিকতা, পাশবিকতার পরিমাণ কতটা নিচে নেমে গেছে, আয়াতের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারও তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আমাদের সমাজে কতটা পচন ধরেছে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ এই ভয়াবহ-নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। একটা মাসুম শিশুর ছোট্ট শরীর কেটে টুকরো টুকরো করতেও আজ আমাদের হাত কাঁপে না—আজকের সমাজের অধঃপতনের চরম বাস্তবতা যেন এটাই!
অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই, এই জনপদে আইনের শাসন বলতেই কিছু নেই। প্রতিনিয়ত কিশোর গ্যাংয়ের নানা লোমহর্ষক অপরাধ সামনে আসছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক সাজা না হওয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যাচ্ছে। আইনের ফাঁকফোকর গলে বের হয়ে আবারও অপরাধজগতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে অপরাধীরা। কোনো ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে কিছুদিন আলোচনা-সমালোচনা হয়। মানববন্ধন, মিছিল হয়। এরপর আবারও সবকিছু আগের মতো হয়ে যায়। কোনো এক অদৃশ্য শক্তির বলে অপরাধীরা আবারও গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কী অদ্ভুত কথা! যেহেতু ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করে কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছি না আমরা; সুতরাং এই ভূখণ্ডে সংঘটিত প্রতিটি অপরাধের দায় আমাদের ওপরেই বর্তায়।
বস্তুত, আয়াতের হত্যাকারীর মতো অমানুষ ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অপহরণ করে টাকা আদায় করে সেই টাকায় জীবন চালানোর মতো অবান্তর চিন্তা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তৈরি হওয়াটা এক অদ্ভুত বিষয়। আমরা আসলেই নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্বে আছি। এর থেকে বেশি অমানবিকতা, পাশবিকতা আর কীই-বা হতে পারে! এতে করে স্পষ্ট হয়, আমাদের সমাজ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মানবিক মূল্যবোধ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অপসংস্কৃতি, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অসচেতনতা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব সমাজে এতটাই শিকড় গজিয়েছে যে, এখান থেকে বের হতে পারাটা বেশ মুশকিল।
আয়াতের পরিবারের মতো ভুক্তভোগীদের সার্বিক সহযোগিতা দিতে হবে। খুনিকে সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। একই সঙ্গে এমন ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সেই ব্যবস্থার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে। সচেতন থাকতে হবে প্রতিটি পরিবারকে। কোনোভাবেই সন্তানকে একা ছাড়াটা ঠিক হবে না। এ ধরনের ঘটনার লাগাম টানতে আরো বেশি সজাগ-সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও। ভিকটিমকে বাঁচাতে নিতে হবে ‘র্যাপিড স্টেপ’। সত্যিকার অর্থেই, সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা বাড়ানোটা আজকের দিনে অনেক বেশি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।