ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির দু’জন নেতা ইসলামের নবী মোহাম্মদ সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করার পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এর বিরুদ্ধে যেভাবে ক্ষোভ বাড়ছে, তার কারণে ভারত সরকার পরিস্থিতি শান্ত করতে কিছু ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে।
ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মা গত মাসে এক টেলিভিশন বিতর্কে এই মন্তব্য করেছিলেন। আর দলের দিল্লি শাখার মিডিয়া ইউনিটের প্রধান নভিন জিন্দাল এ বিষয়ে টুইটারে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন।
তাদের মন্তব্য, বিশেষ করে নূপুর শর্মার কথা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে বেশ ক্ষুব্ধ করে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতিবাদ বিক্ষোভও হয়েছে।
নূপুর শর্মা ইসলামের নবী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন, তা বেশ আক্রমণাত্মক এবং অবমাননাকর।
বিজেপির এই দুই নেতা এরই মধ্যে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন। অন্যদিকে বিজেপি মিজ শর্মাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে, আর মি. জিন্দালকে দল থেকেই বহিষ্কার করেছে।
এক বিবৃতিতে দলটি বলেছে, “বিজেপি কঠোরভাবে যে কোন ধর্মের যে কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে অপমানের নিন্দা করে। বিজেপি কোন সম্প্রদায় বা ধর্মকে অপমান করে, বা হেয় করে- এমন যে কোন আদর্শেরও বিরুদ্ধে । বিজেপি এধরণের মানুষ বা দর্শনকে সমর্থনও করে না।”
সমালোচকরা বলছেন, মিজ শর্মা এবং মি. জিন্দালের মন্তব্য আসলে ভারতে গত কয়েক বছরে যে তীব্র ধর্মীয় মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে, তারই প্রতিফলন। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক কথাবার্তা এবং আক্রমণ নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ভারতের এই অভ্যন্তরীণ বিষয় এখন যেরকম আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে, তাতে করে বিজেপির নেয়া এই পদক্ষেপ হয়তো যথেষ্ট নয়।
কুয়েত, কাতার এবং ইরান এরই মধ্যে রবিবার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সৌদি আরবও সোমবার এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছে।
কাতার বলেছে, তারা প্রত্যাশা করে ভারত যেন এবিষয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “এধরণের ইসলাম বিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য যদি কোন শাস্তি পেতে না হয়, যদি এটা অব্যাহত থাকে, তাহলে সেটি মানবাধিকারের জন্য এক গুরুতর হুমকি এবং এর ফলে হয়তো বিদ্বেষ আরও বাড়বে, সংঘাত এবং ঘৃণার একটা চক্র তৈরি হবে।”
সৌদি আরবও তাদের দেয়া বিবৃতিতে বেশ কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছে। “বিজেপির মুখপাত্র যে মন্তব্য করেছেন সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার নিন্দা করছে।”
কাতারে ভারতের রাষ্ট্রদূত দিপক মিত্তাল বলেছেন, মূলস্রোতের বাইরের কিছু লোকের মন্তব্য কোনভাবেই ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন করে না।
বিজেপির সিনিয়র নেতারা এবং অন্যান্য কূটনীতিকরাও এসব মন্তব্যের নিন্দা করেছেন।
সাতান্নটি মুসলিম দেশের জোট অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) এবং পাকিস্তানও ভারতের সমালোচনা করেছে। তবে দিল্লি আবার পাকিস্তান এবং ওআইসি- উভয়ের সমালোচনা করে বলেছে, “এ বিষয়ে তাদের মন্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সংকীর্ণ মনের।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত সরকার এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে হয়তো এ বিষয়ে একটি প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে হতে পারে। তারা বলছেন, এটি না করলে হয়তো ভারতের সঙ্গে আরব বিশ্ব এবং ইরানের সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে।
ভারতের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। ২০২০-২০২১ সালে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮৭ বিলিয়ন ডলার। এই জোটে আছে কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান এবং ইউএই।
লাখ লাখ ভারতীয় এসব দেশে কাজ করে, এরা কোটি কোটি ডলার রেমিটেন্স স্বদেশে পাঠায়। ভারতে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি আমদানিও করা হয় এসব দেশ থেকে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর এসব দেশে নিয়মিত সফরে গিয়েছেন। এরই মধ্যে ভারত ইউএই’র সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সই করেছে এবং জিসিসির সঙ্গে আরও একটি ব্যাপক-ভিত্তিক বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদী ২০১৮ সালে আবুধাবিতে একটি হিন্দু মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। তখন এটিকে ভারতের সঙ্গে উপসাগরীয় অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উদাহরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
গত কয়েক বছরে দিল্লির সঙ্গে তেহরানের যদিও আগের মতো উষ্ণ সম্পর্ক নেই, তারপরও এই বিতর্ক ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবোল্লাহিয়ানের আসন্ন ভারত সফরে প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিতর্ক এমনকি ভারতের সাম্প্রতিক কিছু সাফল্যের ওপরও কালো ছায়া ফেলতে পারে।
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক জিতেন্দ্র মিশ্র বলেন, “বর্তমান সরকার উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য সত্যিকারের কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল এবং এর ফলে সম্পর্ক বেশ পাল্টে গিয়েছিল। ইউক্রেন সংকট সরকার যেভাবে মোকাবেলা করেছে, সেটাও একটা উজ্জ্বল সাফল্য।”
“কিন্তু এধরণের আগুন নেভানোর কাজ কূটনীতিকদের ওপর না চাপানোই ভালো। আমরা কূটনীতিকরা আমাদের বন্ধুত্বের বৃত্ত বাড়ানোর কাজটা ভালোই করতে পারি, কিন্তু যখন এরকম ঘটনা ঘটে, সেটা খুব প্রীতিকর নয়।”
আরেকজন সাবেক কূটনীতিক অনিল ট্রিগুনায়াত, যিনি আরব বিশ্বে কাজ করেছেন, তিনি বলছেন যে ভারত এখন এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। কেবল নেতৃত্বের উচ্চ পর্যায় থেকে আন্তরিক চেষ্টার মাধ্যমেই একটা নেতিবাচক বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব।
“আইনের অধীনে একটা দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে করে মূলস্রোতের বাইরের কিছু লোকজন এরকম কাজের পুনরাবৃত্তি করতে না পারে, সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে এবং দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করতে না পারে”, বলছেন তিনি।
অন্যান্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিতর্কের ফলে যে কূটনৈতিক মূল্য দিতে হবে, তা উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের স্বার্থের বিরাট ক্ষতি করতে পারে।
“বিদেশি রাষ্ট্র যখন ভারতের কোন অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সমালোচনা করে, ভারতীয় কর্মকর্তারা কিন্তু তখন প্রায়শই বেশ তীব্রভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে প্রতিক্রিয়া দেখান। কিন্তু এবারের ক্ষেত্রে ভারতীয় কূটনীতিকরা খুব দ্রুত উত্তেজনা প্রশমনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা থেকে শুরু করে ক্ষতি সারানোর আরও নানা কৌশল নেবেন, সেটাই দেখতে পাবেন বলে আশা করতে পারেন,” বলছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের এশিয়া কর্মসূচির পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান।
আরব দেশগুলোও তাদের নিজ নিজ দেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ প্রশমনের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়ার উপায় খুঁজছে। এসব দেশে ভারতের সমালোচনা করা হ্যাশট্যাগ সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই আলোচিত হচ্ছে এবং অন্যান্য গণমাধ্যমেও এটি বড় খবর হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন কোন হ্যাশট্যাগে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হচ্ছে। কাতার এবং কুয়েতে কিছু কিছু দোকানপাট ভারতীয় পণ্য তাদের তাক থেকে সরিয়ে নিচ্ছে এমন খবরও আসছে।
মি. কুগেলম্যান বলছেন, জিসিসি এবং ভারত – উভয়ের তরফ থেকেই তাদের সম্পর্ক বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং কিভাবে সম্পর্কের ক্ষতি করার ঝুঁকি এড়ানো যায়, সেটা নিয়ে হয়তো দুই তরফ থেকেই ভাবা হবে।
“কৌশলগতভাবে এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল থেকে এরকম ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার যদিও কারণ আছে, একই সঙ্গে ভারতের যে শক্তিশালী অবস্থান এবং প্রভাব, সেটাও তাকে কিছুটা রক্ষা করবে। নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থেই উপসাগরীয় দেশগুলোর ভারতকে দরকার, যেন ভারত তাদের জ্বালানী আমদানি অব্যাহত রাখে। তারা চায় ভারতীয়রা উপসাগরীয় দেশগুলোতে আসুক, কাজ করুক, বসবাস করুক। সব মিলিয়ে তাদের ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন চালিয়ে যাওয়া দরকার”, বলছেন তিনি।
মাইকেল কুগেলম্যান আরও বলেন, ভারতে মুসলিম বিরোধী মন্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এই দেশগুলো কতদূর পর্যন্ত যাবে, সেটারও হয়তো একটা সীমা আছে।
সমালোচকরা বলছেন, ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেখানে ধর্মীয় মেরুকরণ বেড়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহে উত্তেজনা বিশেষ করে বেড়ে গেছে। কিছু হিন্দু গোষ্ঠী বারানসির এক আদালতে গিয়ে সেখানকার এক শতাব্দী প্রাচীন মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়েছে, তারা দাবি করছে এই মসজিদ তৈরি করা হয়েছে একটি মন্দির ধ্বংস করে তার ওপর।
এই ইস্যুতে টিভি চ্যানেলগুলোতে উস্কানিমূলক বিতর্ক অনুষ্ঠান করা হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ঘৃণা-বিদ্বেষের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। দক্ষিণ-পন্থী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এ নিয়ে প্রায়শই বিতর্কিত বিবৃতি দিয়েছেন।
সমালোচকরা বলছেন, বিজেপি যতই দাবি করুক নূপুর শর্মা মূলস্রোতের বাইরের কেউ, তিনি মোটেই তা নন। তিনি বিজেপির দলীয় মুখপাত্র, দলের মতামত তুলে ধরা তারই দায়িত্ব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিতর্কের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত যে ধরণের বেকায়দায় পড়েছে, সেটি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে তাদের সতর্ক হওয়া দরকার।
“দিল্লি এখন বুঝতে পারছে যে, দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান বিষাক্ত রাজনীতির যে ধারা চলছে, তার ফলে এখন কোন কিছু ভারতের ভেতরে ঘটলেও সেটা আর ভারতের সীমানায় আটকে থাকছে না। বিশ্বে ভারতের প্রভাব যখন বাড়ছে, বাইরে তার কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক যখন আরও জোরালো হচ্ছে, তখন তার আভ্যন্তরীণ রাজনীতি কোন আন্তর্জাতিক অসন্তোষ তৈরি করলে সেখানে ভারতের অনেক বেশি স্বার্থ কিন্তু ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে,” বলছেন মাইকেল কুগেলম্যান।