বিশ্ব জুড়ে খবর বেরিয়েছে ইরানে দীর্ঘ দু’মাস হিজাব-বিরোধী আন্দোলনের ফল পাওয়া গিয়েছে। ইরানে আর নীতিপুলিশের অত্যাচার নেই। নীতিপুলিশ সরকার থেকেই উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদি খবরটি সত্য হতো, তাহলে বাধ্যতামূলক হিজাবও উঠে যেত, মেয়েরা হিজাব ছাড়াই রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। মেয়েরা তো এখনও রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। এখনও হিজাব না পরলে স্কুল কলেজ থেকে মেয়েদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। তাহলে মিথ্যে খবরটা কেন প্রচার হলো? বিশ্বকে বোকা বানাবার জন্য, অথবা ইরানের জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। এ ছাড়া আর কী?
ইরানের প্রতিবাদী সাহসী মেয়েরা জানিয়ে দিয়েছে তারা আন্দোলন থামাচ্ছে না। তারা রাস্তা থেকে সরছে না যতক্ষণ না পর্যন্ত ইসলামী শাসক ক্ষমতা থেকে না সরছে। ইরানের সরকারের মতো কট্টর ইসলামি এবং নারীবিরোধী বর্বর সরকারের বিরুদ্ধে ইরানের জনগণ যেভাবে রুখে দাঁড়াচ্ছে, তার তুলনা হয় না। সরকারি পুলিশ প্রতিবাদী মেয়েদের একের পর এক খুন করছে, রক্তে ভেসে গেছে রাজপথ, তারপরও আন্দোলনের ধার কমছে না, মেয়েরা পিছু হটছে না। এই আত্মত্যাগ শুধু সমাজ সংস্কারক হলেই সম্ভব হয় না, স্বপ্নবান হতে হয়। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে পারলে তা সমাজের জন্যই ভালো, ভবিষ্যৎ জনগণের জন্য ভালো। এই ভালোর কথা ভেবে মেয়েরা খুন হতে দ্বিধা করছে না। এই মেয়েদের আমি কুর্নিশ করি।
আমি কুর্নিশ করি চীনের মতো একটি চরম অগণতান্ত্রিক দেশে তিয়ানানমেন স্কোয়ারের রক্তাক্ত ইতিহাসের পরও সরকার বিরোধী আন্দোলন যারা করছে, সেই সাহসী নারী পুরুষকেও। ১৯৮৯ সালে বেজিংএর তিয়ানানমেন স্কোয়ারে গণতন্ত্রের জন্য অবস্থান ধর্মঘট করা ১০ হাজার ছাত্রছাত্রীকে এক রাত্তিরে মেরে ফেলেছিল চীন সরকার। ছাত্রছাত্রীর ওপর মিলিটারির ট্যাংক চালিয়ে দিয়েছিল, ট্যাংক থেকে ছাত্রছাত্রীকে লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করেছিল সরকারের গণতন্ত্রদমন বাহিনী। এর পর থেকে চীন দেশে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সরকার-বিরোধী কণ্ঠস্বর। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর এতকাল পর আবার শোনা যাচ্ছে। সরকারের জিরো-কভিড পলিসি সাধারণ জনগণের জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছে। তাদের হাউজিং কমপ্লেক্সের ফটকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, কাউকে বাইরে বের হতে দিচ্ছে না, কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছে না ভেতরে। চারদিকে জিরো-কভিড পলিসির ব্যারিকেডের কারণে বাড়িতে আগুন লাগলে দমকল বাহিনী ঢুকতে পারছে না, মানুষ আগুনে পুড়ে মরছে। কেউ পলিসির সমালোচনা করলে সরকারি জিরো-কভিড বাহিনী তার ঘরে ঢুকে বেদম পিটিয়ে আসছে। এরপরও বিশ্ববাসীকে অবাক করে শত শত চীনে লোক পথে নেমে পলিসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, পুলিশের লোকেরা প্রতিবাদ ঠেকাতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও নেমে পড়ছে। চীনের এমন চেহারা তিয়ানানমেন স্কোয়ারের ঘটনার পর কেউ দেখেনি। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনেকে ধারণা করছে এই আন্দোলনই হয়তো গণতন্ত্রের আন্দোলনে রূপ নেবে।
আমি তো মনে করি ইরানের হিজাব-বিরোধী আন্দোলনও গণতন্ত্রের আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। হয়তো ইরানেও সম্ভব হবে না ইসলামি রাজত্ব উপড়ে ফেলতে, আর চীনেও সম্ভব হবে না সমাজতন্ত্রের নামে যে একনায়কত্ব চলছে তা নির্মূল করতে। কিন্তু বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আজ সফল না হলেও কোনও একদিন সফল হবে। অন্তত যে কোনও বর্বরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যে করা যায়, জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানুষ যে পথে নামতে পারে, তার প্রমাণ আজ দিচ্ছে ইরান এবং চীনের বিদ্রোহীরা। তাদের দেখে বিশ্বের নিপীড়িত নিষ্পেষিত অধিকারবঞ্চিত অসহায় মানুষ যুগে যুগে রুখে ওঠার প্রেরণা পাবে। সমতার জন্য, সমানাধিকারের জন্য, স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে। সমতা, সমানাধিকার, স্বাধীনতাবিহীন যে জীবন, সে জীবন কারওরই কাক্সিক্ষত জীবন নয়। সে জীবন বেদনার আর দীর্ঘশ্বাসের, সে জীবন অপেক্ষা করে সত্যিকার গণতন্ত্রের।
২. দেশভাগটা আমার কাছে খুব হাস্যকর একটা ছেলেখেলা বলে মনে হয়। অন্নদাশংকর রায় ঠিকই বলতেন, বুড়ো খোকারা ভারত ভেঙে ভাগ করেছে। গৃহযুদ্ধ এড়াতে ভারত ভাগ করা হয়েছিল। গৃহযুদ্ধে যত মানুষ মারা যেত, আমার বিশ্বাস, তার চেয়ে পাঁচগুণ মানুষ মরেছে ভাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। দশ লক্ষ মানুষ মরেছে দাঙ্গায়। দেশভাগের ফলে আরও ধর্ম, আরও মৌলবাদ, আরও হিংস্রতা, আরও শত্রুতা, আরও ক্ষুদ্রতা জাঁকিয়ে বসেছে উপমহাদেশে।
দেশটা ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। সে কারণেই ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছে বিভক্ত অঞ্চল। পাকিস্তান হয়ে উঠেছে ধর্মীয় মৌলবাদী দেশ, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও বাংলাদেশও ধীরে ধীরে পাকিস্তানের পদাঙ্কই অনুসরণ করছে। আর ভারত! উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের চেয়েও ভালো গণতন্ত্র, ভালো অর্থনীতি, শিক্ষা স্বাস্থ্যের ভালো ব্যবস্থা নিয়েও, এমনকী মঙ্গলগ্রহ প্রদক্ষিণ করতে নভোযান পাঠানোর ক্ষমতা নিয়েও মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত করতে পারছে না। ধর্মে ছেয়ে আছে দেশটা। দিকে দিকে বাবা। দিকে দিকে মন্দির আর পুজো। দেশভাগ না হলে ভারতবর্ষ ধর্মের কবল থেকে অনেকটাই মুক্ত হতো বলে মনে হয়। মুসলমানরা কবে না জানি ভারতবর্ষটা দখল করে নেয়- হিন্দু ধর্মটাকে ধ্বংস করে ফেলে এই ভয়টা হয়তো হিন্দুদের অনেকের মধ্যে এত কাজ করতো না, ধর্মকেও এভাবে তারা আঁকড়ে ধরতো না। ধর্মান্ধতামুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে বেড়ে উঠলে, ভালো শিক্ষা পেলে, মুসলমানের হিন্দু বিদ্বেষটা হয়তো যেতো, এখনকার মতো মৌলবাদী হওয়ার সুযোগ পেতো না। দুই সম্প্রদায়ই আরও বেশি বিজ্ঞানমনস্ক হতো, কুসংস্কারমুক্ত হতো। এ আমার মনে হওয়া। হয়তো এ শুধু মনে হওয়াই, বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এত যে দেশ নিয়ে আমি মগ্ন থাকি, দেশ দেশ করে মরি, আমি কি তাহলে খুব বড় দেশপ্রেমিক?
দেশপ্রেমিক মানে যদি যা কিছুই দেশ করুক দেশকে সমর্থন করতে হবেই, দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হবে, তাহলে আমি দেশপ্রেমিক নই। জাতীয়তাবাদী মানে যদি যে করেই হোক দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, তাহলে আমি জাতীয়তাবাদীও নই। টুকরো টুকরো রাজ্যে বা দেশে আমি বিশ্বাসী নই। দেশে দেশে যে সীমানা, যে কাঁটাতার- তা আমি জরুরি বলে মনে করি না। আমি পৃথিবীর সব দেশকে একত্র করার পক্ষে। যে ইউরোপ এক সময় যুদ্ধে মেতে থাকত, সেই ইউরোপও আজ এক হয়ে গেছে। বিভেদ বিচ্ছেদ ভুলে পরস্পরের সহযোগিতায় সামনে পা ফেললে যাত্রা নিরাপদ হওয়ার সম্ভাবনা সবসময়ই বেশি। আমরা বেড়াল জাতের প্রাণী নই। নিজের চৌহদ্দিতে একা একা বাস করা আমাদের রীতি নয়। আমাদের পূর্বপুরুষ তো সদলবলেই আফ্রিকা ছেড়ে অজানা বিশ্বের দিকে পা বাড়িয়েছিল। আমরা একা একা বিবর্তিত হইনি। শুরু থেকেই আমরা একসঙ্গে থাকার পক্ষে। রাজনীতিকরা আমাদের আলাদা করেছে। এক মানুষজাতকে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতে ভাগ করেছে। দেশের সীমানা এঁকে দিয়েছে। বিচিত্র মানচিত্র দিয়েছে। ভুলটা রাজনীতিকদেরই।
আমি যে দেশে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, সে দেশে যা কিছু অবিচার অত্যাচার দেখি, প্রতিবাদ করি। কিন্তু এমন নয় যে দুনিয়ার অন্য কোথাও অবিচার অত্যাচার দেখলে প্রতিবাদ করি না। কেন এত রুখে উঠি, কেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই! তাড়াই কারণ পৃথিবীটা সুন্দর হোক চাই। পৃথিবীতে মানুষ ভালোবাসা পেতে পেতে, সুখ আনন্দ পেতে পেতে বাঁচুক, চাই। জীবন তো একবারের জন্যই আসে। জীবনের মতো অমূল্য সম্পদকে হিংসে, যুদ্ধ আর বর্বরতা দিয়ে মলিন করার, অশান্তিময় করার, দুর্যোগ-দুর্দিন-দুশ্চিন্তা দিয়ে নষ্ট করার কোনও অর্থ হয় না।
আমি তাড়াতে চেয়েছি যাবতীয় অসভ্যতা, আর আমাকে বাহবা না দিয়ে উল্টে আমাকেই দেশ থেকে তাড়িয়েছে সরকার। উগ্রপন্থি মৌলবাদীদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই। দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র থাকলে আমার ভিন্নমতের জন্য আমাকে নির্বাসন দিতে পারতো না। আমি নির্বাসন দণ্ড ভোগ করছি, একই সঙ্গে পৃথিবীটাকে আরও কাছ থেকে দেখার, আরও আপন করে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। এক অঞ্চলকে আঁকড়ে ধরে থাকলে আরেক অঞ্চল সম্পর্কে অজ্ঞতাই রয়ে যায়। আমার কাছে সত্যি বলতে কোনও অঞ্চলই আলাদা নয়। সবই পৃথিবীর উত্তর দক্ষিণ, অথবা পূর্ব পশ্চিম।