কোভিড-১৯ অতিমারির প্রাক্কালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি)-এর প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২২ অনুসারে, প্রতিদিন বিশ্বের ৬৯ কোটি মানুষ খালি পেটে বিছানায় যায়। বাংলাদেশে ৬৮ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২২ অনুসারে, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা বিশ্বের ৪৫টি দেশের তালিকায় নাম রয়েছে দেশটির।
জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানিসংকট, বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি, সার ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত, টাকার দরপতন, মূল্যস্ফীতি, ইত্যাদি খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকটের কারণে আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্যের এলসি খোলা কমে যাচ্ছে, ফলে আমদানিও কমে যাচ্ছে। আমদানি কমে যাওয়ায় সরবরাহ-সংকটের অজুহাতে খাদ্যপণ্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে, ফলে মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে। বিবিএস ২০২২-এর হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২২-এর ক্ষুধাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২১টি দেশের মধ্যে ৭৬ থেকে অবনতি হয়ে ৮৪তম স্থানে নেমে এসেছে। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি (আইপিসি)-এর প্রকাশিত ফেইজ ক্ল্যাসিফিকেশন ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন মাঝারি মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।
জাতিসংঘের প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জে প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২২ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নিকট ভবিষ্যতে পানিসংকট আরও তীব্র হবে। ফলে ফসল উৎপাদন আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের তীব্রতা বাড়াবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ ২৫টি দেশ তাদের নিজেদের প্রয়োজন মেটানোকে প্রাধান্য দিয়ে ৬৪টি পণ্য (যেমন :গম, ময়দা, সবজি, ডাল, ভোজ্য তেল, মাছ, মাংস, সার, ইত্যাদি) রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
জ্বালানিসংকট, খাদ্যসংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসংকট পুরো বিশ্বকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নিঃসন্দেহে আমরা একটি অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অনাগত সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে এবং সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে কৃষি অগ্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে আলাদাভাবে গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে।
কোভিড-১৯ অতিমারির মতো জরুরি পরিস্থিতিতে দেশের সুষ্ঠু ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের কৃষি খাত শুধু সফলভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে তা নয় বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম দিকে লক-ডাউনের কারণে বাংলাদেশে যখন সব কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, জীবনযাত্রা থমকে গিয়েছিল তখন কিন্তু কৃষকরা এক দিনের জন্যও ঘরে বসে থাকেনি, কৃষি উৎপাদন বন্ধ থাকেনি। এরকম একটা জরুরি পরিস্থিতেও খাদ্যোত্পাদন, আয়বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ এবং শিল্পপণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের মাধ্যমে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৪২ দশমিক ৭ এখনো কৃষি খাতে নিয়োজিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২২ অনুসারে কোভিড-১৯-কালীন ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষি খাত মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি ও অগ্রগতিতে অবদান রেখেছে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এ বছর সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং উত্তর অঞ্চলের বন্যায় ৫৬ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান এবং ৫ থেকে ৬ হাজার হেক্টর জমির শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে এবার বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে মাছচাষ এবং আমন ধান আবাদ ব্যাহত হয়েছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে খুলনা অঞ্চলের প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমির আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও কৃষিপণ্যের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার অন্যতম প্রধান সমস্যা। বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ফসল নষ্ট হয় সংরক্ষণ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে। বিবিএসের কৃষি-উপাত্ত অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর মোট উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ কৃষিপণ্যের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হয়, যেমন পেঁয়াজ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ, আলু ৫ থেকে ৮ শতাংশ, ডাল ৫ থেকে ৬ শতাংশ, আম ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ইত্যাদি। একইভাবে অন্যান্য দানাদার শস্য যেমন ফলমূল, শাকসবজি, কাঁচা মরিচ, আদা ও রসুন, ইত্যাদি ফসলের ব্যাপক সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হয় প্রতি বছর। হিমাগার বৃদ্ধি এবং ফুড প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের পচন রোধ করা যেতে পারে। ফসল সংগ্রহের মৌসুমে অথবা তার পরবর্তী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে স্ব স্ব পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, বিশেষ করে চাল, পেঁয়াজ ও ডালজাতীয় পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে।
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারকে শুধু খাদ্যোত্পাদনে জোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই চলবে না বরং খাদ্যপণ্য বিতরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্যের ওপর প্রয়োজনীয় গবেষণা করে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও ফসলের জাত হস্তান্তরের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সার ও বীজের সরবরাহ নিশ্চিত করে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে, প্রয়োজনে তাদের প্রণোদনা দিতে হবে।
দেশের প্রতি ইঞ্চি আবাদি জমি চাষ করার লক্ষ্যে জোর প্রচারণা চালানো যেতে পারে। প্রয়োজনীয় সার, বীজ, কীটনাশক, সহজ শর্তে কৃষি ঋণ এবং আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ বাড়িয়ে উত্পাদনসহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা যেতে পারে। ডিজেলের দাম বাড়ার সঙ্গে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং দ্রব্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার যাচাই-বাছাই করে ভর্তুকি দিয়ে হলেও ডিজেলের দাম কমানোর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
গুণগত গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে, প্রতিটি ইউনিয়নকে একেকটি উৎপাদনশীল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আইজিএ ম্যাপিং (ড. খুরশিদ আলম কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি মডেল) ব্যবহার করা যেতে পারে। কৃষিকাজ এবং কৃষিপণ্য বিপণনের জন্য মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে এবং মোবাইল ব্যাংকিংকে আরও সহজলভ্য এবং সেবা প্রাপ্তির ব্যয় কমিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় সার আমদানিতে দ্রুত অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করা যেতে পারে। সার রপ্তানিকারক দেশসমূহ যেমন কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, মরক্কো, তিউনিসিয়ার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করা যেতে পারে। কীটনাশক আমদানির ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।
সরকারের পাশাপাশি জনগণকে এখন থেকে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স প্রতিবেদন ২০২১ অনুসারে, বাংলাদেশে বছরে ১ কোটি ৬ লাখ টন খাদ্য অপচয় হয় এবং একজন বাংলাদেশি নাগরিক বছরে গড়ে ৬৫ কেজি খাবার অপচয় করে। সুতরাং আমাদের খাদ্য অপচয়ের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয় মালিকানাধীন কোনো আবাদি জমি ফেলে রাখা যাবে না। নিচু জমিতে মৎস্য চাষ, মধ্যম উঁচু জমিতে ধানচাষ, উঁচু জমিতে শাকসবজি ও ফলের চাষ করতে হবে। যাদের জমি নেই, ইজারা নিয়ে হলেও যেন তারা নিজেদের কৃষিকাজে নিয়োজিত রাখে। গ্রাম পর্যায়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চিত টাকা অলস ফেলে না রেখে, কৃষিতে বিনিয়োগ করে বাজারনির্ভরতা কমাতে পারে। সীমিত আয়ের মানুষ তিন-চার মাসের জন্য তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সঞ্চয় রাখতে পারে। অতিরিক্ত ভোগ ব্যয় কমানোসহ চিনি, পেঁয়াজ ও সয়াবিন তেলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে হবে।
কৃষিতে বিনিয়োগের অভ্যন্তরীণ রিটার্নের হার শিল্পের তুলনায় কম এবং কৃষি বিনিয়োগের রিটার্ন পেতে নির্দিষ্ট একটা সময় দরকার হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এই খাতে বিনিয়োগে কম উত্সাহী। কৃষি খাতকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সরকারকে কৃষিভিত্তিক ই-কমার্স ব্যবসার প্রসার এবং তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে উদ্ভাবনী হতে হবে। কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে এবং তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে আর কী কী করা যেতে পারে, সে বিষয়েও গবেষণা পরিচালনা করতে হবে। কৃষিবিপ্লবের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের কঠোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।