পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন এক শিল্পবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন বরিশালবাসী। স্বপ্নের সেতুর মাধ্যমে এ অঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে (এন-৮) ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে।
ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সড়কপথে বরিশালের সংযোগ স্থাপন হবে। সেতুকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে বরিশাল বিভাগে ছোট-বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রণোদনা দিলে অল্প সময়ে এ অঞ্চলে গড়ে উঠবে বৃহৎ, মাঝারি, ক্ষুদ্র শিল্প। এসব কারখানায় দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
এখানে উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা যাবে। মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এ অঞ্চল। এছাড়া পর্যটন শিল্পে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটবে। এ খাতেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ভাঙ্গা-বরিশাল-পায়রাবন্দর মহাসড়ক ফোর লেন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। শিল্পকারখানার জ্বালানি চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত গ্যাসের জোগান লাগবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। শিল্প খাতে দক্ষ উদ্যোক্তা ও জনবল সৃষ্টিতে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি সুবিধাজনক এলাকাগুলোতে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) নির্মাণ করতে হবে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থী ওবায়দুর রহমানের মতে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বরিশালে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাই অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষে এই শহরেই চাকরি করে বাবা-মায়ের সান্নিধ্যে থাকার স্বপ্ন দেখছি।
বরিশাল-মাওয়া রুটের বিএমএফ পরিবহণের চালক টিটুল জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে ভাঙ্গা-বরিশাল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কয়েকগুণ বাড়বে। যেহেতু মহাসড়ক তুলনামূলক সরু তাই যানবাহন চলাচল করতে হবে ধীরগতিতে। তাই দ্রুত মহাসড়ক ফোর লেনে উন্নিত করতে হবে।
ববির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জ্যোতির্ময় বিশ্বাস জানান, পদ্মা সেতুকে ঘিরে বরিশালে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশের নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। এই অঞ্চলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে বেকার তরুণ-তরুণীরা কাজ পাবে। ডিজিপিতেও বিশেষ অবদান রাখবে বরিশাল বিভাগ। পাশাপাশি পর্যটন শিল্প আরও গতিশীল হবে।
বরিশাল বাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার জানান, এই সেতু উদ্বোধন হলে দক্ষিণাঞ্চলের বড় বড় বাস চলাচল শুরু হবে। এসব বাসে কমপক্ষে ৯-১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক কাজী মফিজুল ইসলাম কামাল বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আমরা শিল্পবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছি। শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে দুই লাখ বেকার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের দুই পাশে দপদপিয়া, বিমানবন্দর, গড়িয়ার পাড়, শিকারপুর এলাকায় বেসরকারি পর্যায়ে অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। গড়ে উঠতে শুরু করেছে ছোট-বড় শিল্পকারখানা। দ্রুত সময়ে এ অঞ্চলকে শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে অধিক গুরুত্বের পাশাপাশি বিদেশি পুঁজি আকর্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা ফোরলেন বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পের পরিচালক এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) অতিরিক্ত প্রকৌশলী একেএম আজাদ জানান, জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। অধিগ্রহণ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এরপর সওজ ফোরলেন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করবে।
বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার আমিন উল আহসান জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে বরিশালে অর্থনৈতিক জাগরণ তৈরি হবে। এতদিন যারা এই অঞ্চলে বিনিয়োগ করেননি এখন তারা বিনিয়োগের উদ্যোগী হবেন। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে চাই। এর অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে পটুয়াখালীতে ইপিজেড নির্মাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিনিয়োগ আকর্ষণে সভা-সেমিনারসহ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
চলছে শেষ সময়ের কর্মযজ্ঞ : লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন সামনে রেখে চলছে শেষ সময়ের কর্মযজ্ঞ। ইতোমধ্যে সেতু যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়েছে। চলছে রোড মার্কিং, ম্যুরাল ও নামফলক স্থাপনের কাজ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সেতু এলাকা পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর আগে তিনি সুধী সমাবেশস্থল, ম্যুরাল ও নামফলক স্থাপনের কাজ পরিদর্শন করেন।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মাওয়া প্রান্তের খান বাড়ি সংলগ্ন টোল প্লাজার সামনে সুধী সমাবেশ হবে। সুধী সমাবেশের পর বিকালে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ঘাটে হবে জনসভা। আওয়ামী লীগের এই জনসভায় ১০ লাখ মানুষের অংশগ্রহণ করবে বলে দলটির স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন।
সুধী সমাবেশ সফল করতে মঙ্গলবার সকালে মাওয়া-শিমুলিয়া ঘাটে বিআইডব্লিউটির ড্রেজার বেইজের অডিটোরিয়ামে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুলের সভাপতিত্বে সভায় মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ প্রশাসক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহাম্মেদ, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরী, পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন, সিভিল সার্জন মোহাম্মদ মঞ্জুরুল আলম, লৌহজং উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ ওসমান গনি তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ শিকদার, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন তপন প্রমুখ অংশ নেন।