বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে টিভি চ্যানেলের খবরে জানানো হলো, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ডিএমপি কর্মকর্তাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কমলাপুর মাঠ কিংবা মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ মাঠের যেকোনো একটি স্থানে শনিবার বিএনপির সমাবেশ হবে। বিএনপির কয়েকজন নেতা ও ডিএমপি কর্মকর্তারা সরেজমিন মাঠ পরিদর্শনও করেছেন।
দুই দিনের উত্তেজনা, বিক্ষোভ, ধরপাকড় ও সংঘাতের পরপর সন্ধ্যায় বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠক শেষে বের হয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা (বুলু) সাংবাদিকদের বলেন, গণসমাবেশের জন্য কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম ও মিরপুর বাঙলা কলেজ মাঠ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
পরে এ বিষয়ে বরকতউল্লা বলেন, ‘প্রায় আড়াই ঘণ্টা আলোচনার পর আমরা কমলাপুর স্টেডিয়াম ও মিরপুর বাঙলা কলেজ মাঠ—এ দুটি জায়গা নিয়ে সিদ্ধান্তে এসেছি। এখন যেটা পছন্দ হয়, আমরা সেটার কথা তাদের জানিয়ে দেব। এ ক্ষেত্রে কমলাপুর স্টেডিয়াম আমাদের প্রথম পছন্দ।’ সমাবেশের জন্য ওই দুটি স্থান নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদও। বৈঠক থেকে বের হয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুটি স্থানই আমরা দেখব, তাঁরাও দেখবেন। দুটির মধ্যে একটি ঠিক হবে।’ তিনি বলেন, বিএনপির সমাবেশস্থল নিয়ে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, তা কেটে যাবে।
এ খবর শুনে মনে হয়েছিল, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা চলছিল, তার অবসান হবে। উল্লেখ্য, ৭ ডিসেম্বর দলীয় অফিসের সামনে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষে একজন নিহত ও বহু কর্মী আহত হন। আহত হন কয়েকজন পুলিশ সদস্যও। বিএনপি অফিসে অভিযান চালিয়ে চাল-ডাল-তেলের সঙ্গে কিছু ককটেল উদ্ধার করার দাবি করেছে পুলিশ। যদিও বিএনপির নেতারা বলছেন, এসব সরকারের সাজানো নাটক। পুলিশ যখন অভিযান চালায়, তখন বিএনপির মহাসচিব অফিসের নিচেই অবস্থান করছিলেন। তাঁকে উপরে যেতে দেওয়া হয়নি। সেখানে বিস্ফোরক পদার্থ আছে, পুলিশের কাছে যদি এ খবর থেকে থাকে, তারা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে কেন অভিযানে গেলেন না? পরদিন বিএনপি অফিস এলাকাকে ‘ক্রাইম সিন: ডোন্ট ক্রস’ ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছে পুলিশ। কাউকে অফিসে যেতে দেওয়া হয়নি।
সমঝোতার কাছাকাছি গিয়েও কেন সরকার বিএনপির শীর্ষস্থানীয় দুই নেতাকে শেষ রাতে বাসা থেকে ধরে নিয়ে এল? তাহলে কি সরকার বিএনপির ঢাকার ঘোষিত সমাবেশকে ভয় পেয়ে কঠোর অবস্থান নিল? আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপি সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে। তাঁদের এই অতি কঠোর পদক্ষেপ কি সেই ষড়যন্ত্র ঠেকানোর কৌশল? কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের জানা থাকার কথা যে ষড়যন্ত্র আগাম ঘোষণা দিয়ে হয় না।
তারপরও মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন, সমাবেশের স্থানের বিষয়ে যখন ডিএমপি কর্মকর্তা ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে, তখন ১০ তারিখের সমাবেশটি করতে আর বাধা নেই। এ ছিল রাতের প্রথম ভাগের খবর। শেষ রাতেই নতুন খবর পাওয়া গেল, ডিবি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে।
মির্জা ফখরুলের স্ত্রী রাহাত আরা বেগমকে উদ্ধৃত করে বিএনপির মিডিয়া উইংয়ের কর্মকর্তা শায়রুল কবির বলেন, ‘ডিবি পুলিশের সদস্যরা রাত তিনটার দিকে উত্তরার বাসায় এসে বলেছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তাঁরা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আটক করছেন।’ এর কাছাকাছি সময় ঢাকার শাহজাহানপুরের বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা মির্জা আব্বাসকেও আটক করে নিয়ে গেছেন।
সকালে টিভি ও অনলাইন পোর্টালে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজনৈতিক মহলে নতুন চাঞ্চল্য তৈরি হয়। মির্জা ফখরুলকে যখন ডিবি বাসা থেকে নিয়ে আসে, তখন তাঁরা বলেছিলেন, তাঁর (ফখরুল) বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। একদিন আগেই তিনি আরেকটি মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়ে এসেছেন। মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে ৭০টিরও বেশি মামলা আছে। ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ বলেছেন, ৭ নভেম্বরে বিএনপির অফিসের সামনে পুলিশের ওপর হামলা ও ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাঁদের ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদেই ঘটনার সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু তা ঘটেনি। গ্রেপ্তার থেকে রেহাই পেলেন না মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসও।
একটি দলের দুই শীর্ষস্থানীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করতে হলে রাত তিনটায় বাসা থেকে তুলে আনতে হবে কেন? তাঁরা তো পালিয়ে যাননি। নিজেদের বাসায়ই ছিলেন। সরকারের এই আচরণ কী বার্তা দেবে? ডিবিপ্রধান যখন সাংবাদিকদের ব্রিফ করলেন, তখনই জানা গিয়েছিল বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল ডিএমপিতে আসছে সমাবেশের স্থান নিয়ে আলোচনা করতে। একদিকে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদ, অন্যদিকে ডিএমপির আলোচনা। মনে হচ্ছে, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে সরকারের মধ্যে প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করছে।
নয়টি বিভাগীয় সমাবেশ শেষে আগামীকাল শনিবার (১০ ডিসেম্বর) ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ করার কথা রয়েছে। বিএনপি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশ করতে চেয়েছিল। তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেয় পুলিশ। তাও ২৬টি শর্তে! তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নয়, নয়াপল্টনেই সমাবেশ করার বিষয়ে অনড় অবস্থান জানান বিএনপির নেতারা। এই বিতর্ক-আলোচনার মধ্যে গত বুধবার বিকেলে নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির চার শতাধিক নেতা-কর্মীকে।
প্রশ্ন উঠেছে, সমঝোতার কাছাকাছি গিয়েও কেন সরকার বিএনপির শীর্ষস্থানীয় দুই নেতাকে শেষ রাতে বাসা থেকে ধরে নিয়ে এল? তাহলে কি সরকার বিএনপির ঢাকার ঘোষিত সমাবেশকে ভয় পেয়ে কঠোর অবস্থান নিল? আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপি সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে। তাঁদের এই অতি কঠোর পদক্ষেপ কি সেই ষড়যন্ত্র ঠেকানোর কৌশল? কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের জানা থাকার কথা যে ষড়যন্ত্র আগাম ঘোষণা দিয়ে হয় না।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, সরকার বিরোধী দলকে একটি সমাবেশ করতে দিতে চায় না, সেই সরকার কী করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে? সরকারি দল ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। সেটা তারা করতেই পারে, কিন্তু বিরোধী দলকে গৃহবন্দী করে সরকার নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে কীভাবে?