১৭৯৫ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বাংলা নাটক বিকশিত হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির নানা শাখায় বিপুল পরিমাণ নাট্য-উপাদান বহুপূর্ব থেকেই ছিল। একসময় বাংলাদেশে গ্রামে গ্রামে চলত লোকসংগীত, পালাগান, জারিগান, গাজির গান, কবিগান, মৈমনসিংহ গীতিকা, যাত্রাপালা বিশেষ করে শীতকালে এবং সেখানে শত শত নারী-পুরুষ ১২টা-১টা পর্যন্ত একসঙ্গে রাত জেগে দেখে বাড়ি ফিরত। গ্রামের আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই তা উপভোগ করত। তখন এগুলোই ছিল তাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। কালক্রমে এসব উপাদান থেকেই আধুনিক যুগের বাংলা নাটকের উদ্ভব ঘটে।
খ্রিষ্টপূর্বকাল থেকেই গ্রিক দেশে নাট্যচর্চার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা জানা যায়। পেরিফ্লিসের গ্রিক এবং পরবর্তীকালে এলিজাবেথের ইংল্যান্ডে নাট্যচর্চার ব্যাপক সমৃদ্ধি এসেছিল। প্রাচীন ভারতবর্ষেও সংস্কৃতি নাটক খুব সমৃদ্ধ ছিল। বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশেই নাট্যচর্চা আছে। বাংলা নাটকের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। দেশ-বিভাগের পর থেকেই পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে নাটক রচনায় একটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে।
১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশের নাট্যকাররা ঐতিহাসিক নাটকের পাশাপাশি সামাজিক নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৪৭ থেকে প্রাক-মুক্তিযুদ্ধে কালপর্বে যারা নাটক লিখেছেন তারা হলেন, নুরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সিকান্দার আবু জাফর। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনেক নাট্যকার নাটক লিখেছেন যেমন মমতাজউদদীন আহমদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ (১৯৭৬), আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘নরকের লাল গোলাপ’ (১৯৭৪)। আরও অনেকে আছেন যেমন, মামুনুর রশীদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আল দীন, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর।
নাটক আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের বিশাল স্থান দখল করে আছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে জনসমর্থন তৈরি করে জনতাকে জাতীয়তা বোধে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে মঞ্চস্থ হওয়া যাত্রাপালা এবং নাটক বড় ভূমিকা রেখেছে। শুধু কি তাই, মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধ তৈরিতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম একটি মৌলিক বিষয় ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। তবে ধর্মনিরপেক্ষবাদ বলতে সাধারণত রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথকরূপে প্রকাশ করাকে বুঝায়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে।
১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার স্ব স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে।…ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’ পাকিস্তান আমলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মের নামে যে নির্যাতন পাকিস্তানি সেনারা করেছিল, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সাংবিধানিক কাঠামোয় উপস্থাপন করেছিলেন।
২০২০ সালের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল বিভিন্ন বিতর্কমূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন, যা কিনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
তার নেতৃত্বে গত ২৬ (২০২১) মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সেই বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। ঐ সংঘাতে প্রাণ হারান অন্তত ১৮ জন। ১৮ এপ্রিল তাকে গ্রেফতার করা হয়। এভাবে ধর্মকে অপব্যবহার করে রাজনীতিতে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়ে থাকে, যা কিনা পরবর্তী সময়ে সহিংসতায় রূপ নেয় এবং এর খেসারত দিতে হয় এদেশের সাধারণ মানুষকে।
প্রতিটি নাটকের মাধ্যমে সমাজের প্রতি বার্তা দেওয়া যেতে পারে। নাটক হচ্ছে সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার। সামাজিক অনাচার, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ও কুসংস্কার নিয়ে তৈরি নাটক আমাদের সমাজকে সব সময়ই নাড়া দিয়েছে, পরিবর্তন এনেছে সমাজমননে।
সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে, সঠিক ধারায় প্রবাহিত হতে, সমাজের অসংগতি ও অনাচার দূর করার ক্ষেত্রে এবং মানবিকতা ও মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে নাটক বড় অবদান রাখতে পারে।
একাধারে আবার শিল্পকলা একাডেমি শুরু করেছে বেশ কয়েক বছর ধরে যাত্রাগান পালাগানের। সাহায্য করছে বিভিন্নভাবে এবং একই সঙ্গে এই বাংলার নাটকগুলো শহর এবং গ্রামে বিরাট একটা প্রভাব ফেলছে।
নাটকের মাধ্যমে অনেক বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা যায়। আজকাল মানুষ হাতে হাতে মোবাইল ব্যবহার করছে। যখন খুশি ইউটিউবের নাটক, সিনেমা উপভোগ করতে পারছে। তাই ভালো জিনিসের পাশাপাশি যখন খারাপ কিছু দেখানো হয়, সেটাও মানুষের মনে প্রভাব ফেলে। আজকাল বেশ কিছু নাটকে ধূমপান এবং অ্যালকোহলের বিষয়গুলো বেশি দেখানো হচ্ছে, যা কিনা তরুণ প্রজন্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর এই দুটি জিনিসই স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই জিনিসগুলো যতটা সম্ভব কম দেখানোই ভালো।
সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নাটক ও নাট্যকর্মীরা অতীতে যেমন ভূমিকা রেখেছেন, আর বর্তমান প্রজন্মের কিছু তরুণ ও তরুণী আছেন, যারা তাদের সুনিপুণ অভিনয় দিয়ে ভূমিকা রাখছেন। যেমন:জিয়াউল, ফারুক, অপূর্ব, মেহজাবিন চৌধুরী, তানজিন তিশা, তাসনিয়া ফারিন, আফরান নিশো—এরকম আরও অনেকে আছেন। তাই আগামী দিনের একটি সর্বজনীন বাংলাদেশ যখন আমরা দেখব, তখন এর প্রধান ধারক এবং বাহক হবে এরাই।