হে সূর্য, শীতের সূর্য/ হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায় আমরা থাকি,/ যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ,/ ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।’— সময়ের স্রোতে পরিবর্তিত হয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের শীতের হিমশীতল রাতে শীত নিবারণে সূর্যের উত্তাপের প্রতীক্ষা এখনো বর্তমানে রয়েছে অনেকের জীবনে।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ঋতুর আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পালা করে আসে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। শীতের আগমণে চারদিকে কুয়াশা, শীতের মিষ্টি অনুভূতির সঙ্গে রাস্তার পাশ মুখরিত হচ্ছে ভাঁপা পিঠার ধোঁয়া। কুয়াশা মাখা রাতে ঝাঁক বেঁধে তরুণরা বেরিয়ে পড়ে গরম পিঠা খাওয়ার উদ্দেশ্যে। ফুটপাতে সারি সারি দোকান, হরেক রকমের পিঠা। তবে শুধু তরুণ-তরুণী নয়, শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই আসে শীতের পিঠার স্বাদ নিতে। এ দৃশ্য শীত ঋতুকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে।
তবে শুধু এটাই ফুটপাতের সারা রাতের দৃশ্য নয়। রাতের গভীরতার সঙ্গে বাড়তে থাকে শীতের তীব্রতাও। প্রায় মানবশূন্য হয়ে যায় ফুটপাতগুলো। শীতের তীব্রতা ঠেকাতে সবাই চলে যায় নিজ নিজ বাসস্থানে। কিন্তু তার পরও ফুটপাতেই থেকে যেতে হয় কিছু মানুষকে। কারণ ফুটপাতই তাদের স্থায়ী ঠিকানা। শুধু ঢাকার শহরে ফুটপাতে বসবাস করে প্রায় ৫০ হাজার ছিন্নমূল মানুষ এবং বস্তিগুলোতে থাকছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এ শীতে তাদের ভোগান্তির শেষ নেই, নেই শীত ঠেকানোর মতো ন্যূনতম সম্বলটুকু। তীব্র শীতেও কোনো গরম কাপড় ছাড়াই খড়কুটো জ্বালিয়ে ফুটপাতে কিংবা জীর্ণশীর্ণ ভাঙা ঘরে রাত কাটাতে হয় তাদের। প্রায় সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। এসবের মধ্যে আবার যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এ কারণে বিগত বছরগুলো থেকে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সহায়-সম্বলহীন এ মানুষগুলো শীতের তাণ্ডবে অসহায় হয়ে পড়ছে। গ্রামঞ্চলের দরিদ্র মানুষগুলোও একই পরিস্থিতির শিকার। প্রতি বছর শীতের সময় আমাদের দেশে অসাবধানতাবশত ছোট-বড় অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর অধিকাংশের সূত্রপাত হয় শীত নিবারণের জন্য জ্বালানো আগুন থেকে। দরিদ্র মানুষের জন্য এ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। তীব্র শীতে দরিদ্র মানুষের ভোগান্তি কমাতে আমাদের এগিয়ে আসা উচিত।
আমাদের সমাজের একশ্রেণির মানুষের কাছে শীত মানেই খেঁজুরের রস, গরম গরম পিঠা আর বাহারি সবজির দিন। কিন্তু এর বিপরীতেও একটি দৃশ্য রয়েছে, যা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সহায়-সম্বলহীন এসব মানুষকে শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা করতে প্রতি বছর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন, ধনাঢ্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। উদ্ধত এ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য আরো বেশি সহযোগিতার প্রয়োজন। এ সহযোগিতা নিশ্চিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। একইভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে বিত্তবান সমাজকে। একই সঙ্গে ছিন্নমূল মানুষের জন্য আসা সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা যেন যথাযথভাবে তাদের কাছে পৌঁছায়, সে বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শীতের পালা বদলে সময় যতই বসন্তের দিকে আগাতে থাকে, শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকে ততই। তাই তীব্র শীতে হতদরিদ্র মানুষ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ার আগেই তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে এবং সরকারি উদ্যোগে ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা যেন কোনোক্রমেই ভুলে না যাই—‘মানুষ মানুষের জন্য’।